আবু জিজ্ঞাসা করিলেন–“তোমার বাড়ি?”
পাগলী কহিল–“নদীয়া।”
আবু অত্যন্ত বিস্মিত হইয়া কহিলেন–“নদীয়ায়?”
পাগলী ধীরভাবে কহিল–“হ্যাঁ, নদীয়ায়।”
পাগলী ভীতিহীন মনে জিজ্ঞাসা করিল–“তোমার বাড়ি?”
আবু বিরক্তি প্রকাশ না করিয়াই উত্তর দিলেন ”নদীয়া, আজমপুরে!”
পাগলী অনেকক্ষণ নিস্তব্ধ থাকিয়া কহিল–“আজমপুরের হরিঠাকুরকে চেন? তার বৌকে চেন?”
আবু কহিলেন ”হ্যাঁ চিনি, নাম তার শান্তা; তার মেয়ে নদীর ঘাটে হরিয়ে গিয়েছিলো। তিনি যখন বাড়ি ফিরে এলেন তখন থেকে আর কেউ তাঁকে কথা বলতে বা হাসতে দেখে নি। একদিন তিনি বাড়ি ছেড়ে কোথায় চলে গেলেন! আর সন্ধান হল না। তখন তাঁর যুবতী বয়স। এখনো তাঁর কথা মনে হলে আমাদের দুঃখ হয়। আমাদের অনেকখানি শ্রদ্ধার পাত্র তিনি ছিলেন।”
প্রৌঢ়া বলিল–“আমি সেই!”
বর্ষাকালে মাঠের মাঝে কোনো বালকের মাথার কাছে বজ্রনিনাদ হইলে সে যেমন চমকিত হয়, আবু তেমন চমকিত হইলেন। এই সেই হরিদয়লের বৌ। আবুর সর্বাঙ্গ দিয়া একটা স্পন্দন ছুটিয়া গেল। এই চলন্ত গাড়ির মাঝে কত বছর আগেকার সেই বৌটি, কতকাল ব্যাপী হাজার বিচিত্রতার দাগ নিয়ে, আপ তারই সম্মুখে উপস্থিত। কী বিস্ময়! কী আশ্চর্য!
আবু তাড়াতাড়ি বেঞ্চ ছাড়িয়া মাটিতে বসিয়া পড়িলেন। তার পর তিনি বিছানা হইতে কম্বল টানিয়া মাটিতে বিছাইয়া রমণীকে বসিতে অনুরোধ করিলেন। রমণী কম্বল সরাইয়া রাখিয়া কহিল–“আর সম্মান চাহি না।”
আবু কথা বলিতে পারিতেছিলেন না। শুধু ভাবিতেছিলেন,এত বছর পর হরি ঠাকুরের বৌয়ের তার সঙ্গে এই চলন্ত গাড়ির ভিতর দেখা হইবার কারণ কি? আর এক কথা–সে তো পাগল। এত শৃঙখলা মতো সে কেমন করিয়া কথা কহিতে পারিতেছে?
রমণী বলিলেন–“আজ বহু বৎসর তোমার সন্ধানে আছি–তুমি আমার মেয়ের খবর জান। বল আমার মেয়ে কোথায়?”
আবু ভীত হইয়া পড়িলেন–হরিদয়ালের মেয়ের সঙ্গে তার কী সম্বন্ধ? তার পশ্চাৎ পশ্চাৎ আজ বহু বৎসর রমণী ঘুরিতেছে–তারই বা অর্থ কী?
আবু একটু ভীতির সঙ্গে জিজ্ঞাসা করিলেন–“আমি আপনার মেয়ের সংবাদ জানিলাম কেমন করিয়া?” আবু বিস্ময়ে পুনরায় ভাবিলেন–এক গ্রামের লোক, হরিদয়াল ঠাকুরের স্ত্রী আজ এত দীন ও মলিন বেশে তার সম্মুখে। কোনো কালে শান্তার সঙ্গে সামনাসামনি তার দেখাশুনা বা পরিচয় না থাকিলেও দুঃখে ও সহানুভূতিতে আবুর মন ভরিয়া উঠিতেছিল।
আবু অত্যন্ত বিনীত শ্রদ্ধার কণ্ঠে বলিলেন–“আমি আপনার মেয়ের সংবাদ জানি কেমন করিয়া, দয়া করে বলুন।”
রমণী বলিলেন–“শোন–যেদিন হুগলী থেকে বাড়ি ফিরে যাই সেদিন মনে হচ্ছিল–সংসারে ধর্ম নাই। সংসারের সকল লোকগুলোকে নাপিশাচ বলে মনে হচ্ছিল–ভাবছিলাম মিথ্যা ধর্ম-মিথ্যা ঈশ্বর-মিথ্যা দেবতা-মিথ্যা পূজা!
একটা ভীষণ যাতনায় আমার গলা বন্ধ হয়ে আসছিল–চোখে আমার জল ছিল না। একখানি ছোরা হাতে করে সংসারে সব মানুষগুলোকে খুন করার দারুণ বাসনা হচ্ছিল। ভাবছিলাম যাবৎ একটা মানুষ এ জগতের অত্যাচার ভোগ করে তাবৎ মানুষ কেন উপাসনা করে? এ পূজাগুলিই বা কী? আমাকে এমনি করে পাগল করে ভগবানের কি সুখ হয়েছিল? এটা কি পরীক্ষা? রাক্ষসী আমি; এ পরীক্ষার কোনো মূল্য বুঝি না। এ জগতে এত দুঃখ ও বেদনা কেন? জগৎ যদি সৃষ্টি না হতো তা হলে কে এত দুঃখ ভোগ করতো, কোথায়ও মানুষ স্বর্ণসিংহাসনে বসে স্বর্গসুখ অনুভব করছে,কোথায় মানুষ দুঃখ ও বেদনায় চূর্ণ হয়ে যাচ্ছে।
আমি সেদিন কী যাতনা ভোগ করছিলাম তা কয়েকজন যুবক ছাড়া আর কেউ তো জিজ্ঞাসা করলে না! চন্দ্রসূর্য তেমনি করে উঠেছিল। মানুষের সমাজ তেমনি করে বয়ে যাচ্ছিল। সমস্ত সংসারটা সেদিন পাপ ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে ক্ষেপে উঠলো না কেন? মানুষ কি উপাসনা করে! সে জ্বালার মীমাংসা কোথায় ছিল? চোখের সামনে আমার সোনার শিশুকে চুরি করে নিলে! তখন আকাশ থেকে বজঘাত হল না! কিন্তু আমার শিশুর হাসি,তার সুষমা অমার বুকের কোণায় বেঁধে ছিল। কোনো পাষণ্ড আমায় এমনি করে শ্মশানে বসবার আদেশ দিয়ে গেল?
মানুষ অন্যায় ও পাপ করে। তাদের বুক কাঁপে না, তাদের হাত অবশ হয়ে যায় না। আরও বিচিত্র এই অন্যায় ও পাপের বিরুদ্ধে না দাঁড়িয়ে মানুষ উপাসনা করে। এরই বা অর্থ কী?
বাড়ি এলেম, কিন্তু কী বিস্ময়? শাশুড়ি এলেন আমাকে মারতে। আমারই অমনোযোগিতায় খুকি হারিয়ে গিয়েছে–এই তিনি বল্লেন। আমি হাসি সংবরণ করতে পারলাম না। আমার হাসি দেখে শাশুড়ী আমাকে ঝাঁটা দিয়ে মারলেন। তিনি বললেন–হৃদয়হীনা রাক্ষসী! বুকে তোমার কিছুমাত্র মায়া নেই।”
এতক্ষণে রমণী ‘ভগবান’ বলিয়া একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিলেন।
তার পর আবার বলিতে আরম্ভ করিলেন–“স্বামী হরিদয়াল বুঝেছিলেন আমার সেই হাসির অর্থ কী? দেখতে পেলাম আমার হাসি দেখে তিনি কেঁপে উঠলেন। মায়ের সামনে তিনি কোনো কথা বলতে সাহস করলেন না। তাঁর কথা মনে হলে আমি পাগলী হয়েছি তবুও আমার বুক ফেটে যায়! বালিকা বয়সের স্বামী তিনি আমার। যেদিন বিবাহ হয়, সেদিন প্রাণের শত আশা-আকাক্ষার সিংহাসন গড়ে তাকে সেখানে বসিয়েছিলেন। কোথায় আমার হরি? কয়েকদিন তার সঙ্গে স্বপ্নের ঘর বেঁধেছিলাম। জীবনটা পথে পথে কেটে গেল।