এমদাদ মিঞার স্ত্রী দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলিয়া বল্লেন–“বাবা! ঘরে যার সেয়ানা মেয়ে, তার কাছে কুশল জিজ্ঞাসা করো না! বুকের রক্ত ভাবতে ভাবতে পানি হয়ে গেল।”
আবু দুঃখপূর্ণ স্বরে বলিলেন–“তা ঠিক চাচি! আমার যতদূর সাধ্য তা আমি কচ্ছি এবং করবো।”
এমদাদ মিঞার স্ত্রী জলে চক্ষু ভারিয়া আবুকে আর্শীবাদ করিয়া বলিলেন–“তোরা তো পর নস বাবা। আমার মেয়েও যা, তোর বোনও তাই।”
আবু জিজ্ঞাসা করিলেন–“সম্প্রতি হাছানের বাপের সঙ্গে আর কোনো কথা হয়েছে কি?”
এম-স্ত্রী-তিনি তো অনেক দিন থেকেই আশা দিয়ে আসছেন। তত্রাচ ভরসা পাই না। মেয়ে ক্রমশ বেড়ে উঠছে, চিন্তায় রাত্রে ঘুম হয় না। তুমি বাবা প্রাণপণে একটু চেষ্টা করো। যেন দু’কূল না হারাই।
আবু–আমেনা-লেখাপড়া জানে, কোরান পড়তে পারে, ফারসিও সে বেশ বুঝে। বাংলা-ইংরেজিও তার বাপের কাছে পড়েছে। মেয়ে আপনার সম্পূর্ণ উপযুক্ত। যারা মেয়েকে উপযুক্ত না করে ভালো বর খোঁজে তারা যার পর নাই অন্যায় করে। মেয়ে যার সঙ্গে সারাজীবন বসবাস করবে, তাকে একটু ভালো করেই পরীক্ষা করে, শিক্ষিত লোক বিয়ে করে। যা-তা একটা মেয়েকে একটা শিক্ষিত লোকের গলায় বেঁধে দিয়ে তার সারাজীবনের অভিশাপের পাত্র হওয়া ঠিক নয়। রান্না-সংসার ছাড়া আরও একটা সংসার আছে, সেটা আমাদের গ্রামের লোক বুঝে না, এটা বড় অন্যায় কথা।
এমদাদ মিঞার স্ত্রী আবুর মুখের দিকে তাকাইয়াছিলেন। তিনি সার জীবনের অভিশাপ–আর একটি জগৎ ইত্যাদি কথা বুঝতে না পারিয়া বলিলেন, “বাবা তোরা কত কি বই পড়েছিস–তোরা কত কথা জানিস–তুই যদি চেষ্টা করিস তা হলে তোর বোনের বিয়ে হতে দেরি হবে না। আমেনা লেখাপড়া জানে বাবা! তোরা ছাড়া আর তোর চাচির কেউ নাই। মৌলবী সাহেবের কথা ছেড়ে দাও। মেয়ের কথা বলে বলেন–আল্লাহ মানুষের সুখ-দুঃখের কথা সর্বদা চিন্তা কচ্ছেন। খোদার হাতে সব সঁপে দাও। তুমি আমি চিন্তা করে কী করবো।” কথা তো ঠিক-তাই বলে কি চিন্তা ছেড়ে বসে থাকা যায়।
আবু–তা তো ঠিক চাচি-আচ্ছা আপনি অত চিন্তা করবেন না। আমেনাকে আমি নিজের বোনের মতোই জানি। আমার দ্বারা যা হয় করবো।
এমদাদ–স্ত্রী–আচ্ছা তুমি মধুপুর কবে যাবে।
আবু ডাক্তার বলেছেন যত শীঘ্র সম্ভব যাওয়া আবশ্যক। এবার তো আর বাঁচবার আশা ছিল না।
এমদাদ মিঞার স্ত্রীর চক্ষু জলসিক্ত হইয়া উঠিল।
আবু–মাকে একবার দেখতে এলাম, নইলে ঐ পথ দিয়েই চলে যেতাম। দুই একদিনের মধ্যেই আমি যাত্রা করবো।
এম-স্ত্রী-আচ্ছা, তোমার যাওয়ার আগিই একবার হাছানের সঙ্গে দেখা করে গেলে ভালো হয় না। মুধুপুর গেলে৩/৪ মাসের মধ্যে তো তুমি ফিরে আসতে পারবে না।
আবু–আপনি ব্যস্ত হবেন না। প্রাণপণে আমি চেষ্টা করবো।
এমন সময় বাহির হইতে পিয়ন আসিয়া “সাহেব বাড়ি আছেন?” বলিয়া চিৎকার করিতে লাগিল। আবু এমদাদ মিঞার স্ত্রীকে পুনরায় ছালাম করিয়া বহিরে আসিলেন।
পিয়নের নিকট হইতে একখানি চিঠি গ্রহণ করিয়া আবদার রহমান দেখিলেন, পত্রখানি বন্ধু আহমদ হাছান লিখিয়াছেন।
চেয়ারখানি টানিয়া লাইয়া আৰু পড়িলেন। পত্রে লেখা আছে : ‘প্রিয় বন্ধু, অনেকদিন বাড়ি গিয়াছ। কোনো সংবাদ না পাইযা দুঃখিত আছি। সত্বর কুশল-কথা লিখিয়া চিন্তা দূর করিবা। পরীক্ষা শেষ হইয়া গিয়াছে। ভালোই লিখিয়াছি। খোদার ফজলে পরীক্ষায় কৃতকার্য হইব, কোনো সন্দেহ নাই। তোমার মধুপুরে যাইবার দেরি কত? অনর্থক বাড়ি যাইয়া বসিয়া থাকা অপেক্ষা ইচ্ছা করিয়াছি তোমার সঙ্গে মধুপুরে যাইব!
ইহাতে দুইটি সুবিধা বুঝিতেছি। প্রথম আমার দেশ দেখা হইবে, দ্বিতীয় তোমাকে একটু সেবা করিবার সুবিধা পাইব। আমি প্রস্তুত রহিলাম। তুমি কোনো দিন আসিবে জানিতে পারিলেই আমি ঠিকঠাক থাকিতে পারি।”
বন্ধু হাছানের সহানুভূতি ও প্রেমপূর্ণ পত্র পাইয়া আবদার রহমান যার পর নাই আহলাদিত হইলেন।
কালবিলম্ব না করিয়া পর দিন প্রাতঃকালেই তিনি টেলিগ্রাম করিয়া দিলেন ”আমি অদ্যই সন্ধ্যাকালে রওনা হইতেছি।”
.
ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ
হাওড়ার স্টেশন লোকে লোকারণ্য। মধুপুরের ট্রেনে রাত্রি আটটার সময় ছাড়ে। সেদিন জ্যোৎস্নায় সমস্ত জগৎ প্লাবিত। পূর্ব হইতেই দুইটি সেকেন্ড ক্লাস সিট রিজার্ভ করা হইয়াছিল। সঙ্গে একটি মাত্র চাকর।
হাছানের তামাক টানিবার অভ্যাস ছিল। দিনরাত্রি সমানভাবে চলিত। আবু তামাক পান কিছুই স্পর্শ করিতেন না, বন্ধুর বিরক্তি উৎপাদনের ভয়ে হাছান জানালার পার্শ্বে যাইয়া অনবরত ধূমপান আরম্ভ করিলেন।
গাড়ি যখন আসানসোলে পৌঁছিল তখন একটা বাঙালি প্রৌঢ়া পাগলী গাড়ির দরজায় ধাক্কা দিতে লাগিল। তাহার চেহারা দেখিয়া মনে হয় সে কোনো উচ্চ বংশের মেয়ে ছিল। তাহার আঁখিতে যেন একটা উদাস ও গভীর দৃষ্টি মাখান। সে আসিয়া অত্যন্ত দৃঢ়স্বরে দরজা। খুলিতে বলিল। হাছান তামাকের নল হাতে করিয়া ঘুমাইয়া গিয়াছিলেন। সে গাড়িতে আর কোনোও আরোহী নাই। সুতরাং বাধা দিবার কেহ ছিল না। আবু যন্ত্রচালিতের মতো অগ্র পশ্চাৎ না ভাবিয়া দরজা খুলিয়া দিল।
পাগল যে রূপ করে এই প্রৌঢ়া রমণী সেরূপ বিশেষ কিছু করিল না। গাড়ির ভিতর প্রবেশ করিয়াই সে বললে, “বাবা। আমি পাগল, সময়ে সময়ে আমার মাথা ঠিক হয়।”