বন্ধু এত পরিশ্রম ও যত্ন লইলেও তার দিনগুলি বড় বিরক্তিকর হইয়া উঠিয়াছিল। সম্প্রতি আজ কয়েকদিন হল একটা জোছনার মতো ফুটফুটে সুন্দরী মেয়ে তাহারই পাশের কামরায় এসে বাস করিতেছেন। যুবতাঁকে দেখলে খুব বড় ঘরের মেয়ে বলেই বোধ হয়। তাহার মায়ের হাত পচে গিয়েছিল। কারণ কি তা আবু জানতে পারেন নি। মায়ের শিয়রে একখানা চেয়ার পেতে মেয়েটি রাতদিন বসিয়া থাকে। একটুও তার মুখে বিরক্তির ভাহার নাই।
যুবতী অসাধারণ সুন্দরী। রানীর মতো তাহার সর্বাঙ্গ মহিমা ও সম্পদে ঘেরা। রাতদিন সে মায়ের শিয়রে বসিয়া মাতৃভক্তির পরিচয় দিতেছিল। আবুর মনে ধীরে ধীরে এই মেয়েটির প্রতি একটা শ্রদ্ধার ভাব জাগিয়া উঠিল।
মাঝে মাঝে দুই তিন ঘণ্টা একযোগে বসিয়া থাকিয়া যখন সে ক্লান্ত হইয়া পড়ে তখন চেয়ারখানি টানিয়া বারান্দার রেলিঙ্গের ধারে বসিয়া বই পড়ে। আবুর মনে কৌতূহল উপস্থিত হইল। এমন সুন্দরী মেয়ে লেখাপড়াও জানে, অথচ কোনো পুরুষ মানুষ সঙ্গে নাই। একদিন সন্ধ্যাবেলা আবু ধীরে ধীরে লাঠিতে ভর দিয়ে রেলিঙ্গের পার্শ্বে যাইয়া দাঁড়াইলেন। মেয়েটিকে কি বলিয়া কি জিজ্ঞাসা করিবেন বুঝিতেছিলেন না। অনেক ভাবিয়া জিহ্বার আড়ষ্টতা অতি কষ্টে দূর করিয়া আবু ধীরে ধীরে জিজ্ঞাসা করিলেন ”আপনি ওখানা কী বই পড়ছেন?”
যুবতী সম্ভ্রমের সহিত উঠিয়া দাঁড়াইয়া কহিল ”একখানা কোনো কাজের বই নয়। গল্পের বই মাত্র।”
আবু যুবতীর ভদ্রতায় অত্যন্ত মুগ্ধ হইয়া গেলেন। তিনি মধুর স্বরে বলিলেন ”গল্পের বই তো বাজে বই নয়। ভালো গল্পের বই চরিত্রগঠনে বিশেষ সহায়তা করে। মানবচরিত্রের বিপুল জ্ঞান জন্মে। সংসারের, মানব সমাজের ও মনের অনেক খবর গল্পের বইয়ের ভিতর দিয়ে লাভ করা যায়।”
যুবতী কহিলেন–“তা ঠিক–অনেক দৃষ্টি লাভ হয়।”
আবু পরিচয়ের একটু সুবিধা পেয়ে বললেন–“ইনি আপনার কে?”
সুরী কি বলিবে। তাহার সর্বাঙ্গ দিয়া বিদ্যুতের একটা প্রবাহ বহিয়া গেল। মুহূর্তের মধ্যে সুরী ভাবিয়া লইল–সব কথা আপাতত গোপন করিতে হইবে।
সুরী ধীর ভাবে বলিল, “উনি আমার মা।” সুরী মুহূর্তের মধ্যে ভাবিয়া লইল ভদ্রলোক কি কি কথা জিজ্ঞাসা করিতে পারেন। উচ্চমনা মানুষের সহিত মেশা সুরীর ভাগ্যে কখনও ঘটে নাই। সেও মানুষ। যদি এই সুযোগে একটা ভদ্রলোকের সহিত বা একটা উন্নত আত্মার সহিত সে একটু পরিচয় করিতে পারে তাহাও তাহার পক্ষে লাভ। সমস্ত পৃথিবীর কাছে সে ঘৃণার পাত্র। এই যুবকই যদি জানিতে পারেন তিনি একজন পতিতার সহিত কথা বলিতেছেন, তাহা হইলে লজ্জায় ঘৃণায় তিনি সরিয়া যাইবেন।
সুরী বলিয়া গেল–“এই রুগ্ন মহিলা তাহার মা, এ সংসারে তাদের কেউ নাই। বড় বিপদে তারা পড়েছে। যারা ছিল সবাই মরে গেছে, এক মা ছাড়া তার আর কেউ নাই।”
আবু হৃদয়ে অত্যন্ত দুঃখ অনুভব করিলেন। সহানুভূতিতে তার প্রাণ ভরিয়া উঠিল। সমস্ত রাত্রি সে একা মায়ের শিয়রে জেগে থাকে, কেউ তাকে একটু অবসর দিবার নাই। আবুর ইচ্ছা হইতেছিল এই রুগ্ন দেহেই সে যুবতীর মায়ের সেবায় একটু পরিশ্রম করে।
যুবতী আবুর মনের ভাব বুঝিতে পারিয়া কহিলেন–“আপনি হয়তো আমার কষ্টের কথা ভেবে দুঃখিত হচ্ছেন। আমি একটুও কষ্ট অনুভব করি না। আপনি যদি আমার ভাই হতেন তবে আমি একা আপনাদের দুই জনের সেবা করতে বিরক্ত হতাম না।”
আবু যুবতীর এই অযাচিত স্নেহপূর্ণ হৃদয়ের পরিচয় পাইয়া একেবারে মুগ্ধ হইয়া গেলেন। ভাবিলেন, ঐরূপ দেব-বালিকার সন্ধান তিনি জীবনে কখনও পান নাই।
ক্রমে আর এক মাস কাটিয়া গেল। আবু সহিত সুরীর একটা অপার্থিব সম্বন্ধ জন্মিয়া গেল। প্রথম প্রথম আবু একটু লজ্জা অনুভব করিতেন। কিন্তু তাহার পর একটা প্রগাঢ় মমতার বলে আবু দু’টি নিঃসহায় ভদ্রলোককে অত্যন্ত আপনার জানিয়া ফেলিলেন।
আবুর স্বাস্থ্য ফিরিয়া আসিল। মোহিনীর অবস্থা ক্রমে অত্যন্ত শোচনীয় হইতে লাগিল। তার পর একদিন প্রাতঃকালে আবু হাসপাতাল ছাড়িয়া গেলেন।
হাসপাতাল একটা বিরক্তিকর স্থান হইলেও আবু এই দুই মাসের অবস্থানে এই বিশ্রী স্থানকেও অত্যন্ত ভালবাসিয়া ফেলিয়াছিলেন। আসিবার সময় সুরী তাহার জলে ভরা আঁখি অবনত করিয়া বলিয়াছিল–“আপনাকে ভাইয়ের মতো ভালবেসে ফেলেছি। আমাদের। খবর নিতে ভুলবেন না। আমাদের বাড়ি ৮নং … বাগানে।”
.
দ্বাদশ পরিচ্ছেদ
আজমপুরে আবু মহম্মদ আবদার রহমান তাহাদের পুরানো ছোট দালানের রকের উপর বসিয়া কাগজ পড়িতেছিলেন। বৈকাল বেলার শীতল বাতাস থাকিয়া থাকিয়া প্রবাহিত হইতেছিল। আবুর ছোট বোন আসিয়া বলিল–ভাইজান, চাচি আপনার সঙ্গে কি কথা বলতে চান। তিনি মায়ের কাছে অপেক্ষা কচ্ছেন।”
গ্রাম্য সম্পর্কে এমদাদ আলী মিঞার স্ত্রী আবদার রহমানের চাচি। বিশেষ ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক নয়। তা ছাড়া দূর দেশ হইলে সামান্য সম্পর্কেও যেমন ঘনিষ্ঠতা হয়, গ্রামে আবার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠতা বলিয়া কেউ কাকেও স্বীকার করে না। কেউ কাকেও ঘনিষ্ঠ পরিচয় দিতেও ইচ্ছা করে না।
আবু বুঝিতে পারিয়াছিলেন–তাঁর চাচি কি জন্য তার কাছে আসিয়াছেন। তিনি এমদাদ আলী সাহেবের স্ত্রীর নিকট যাইয়া সালাম করিয়া কুশল জিজ্ঞাসা করিলেন।