মোহিনী আকুল চিৎকারে সুরীকে ডাকিল–“মা! কই তুমি।”
সুরীর চোখে জল! দৌড়াইয়া সে মায়ের কাছে যাইয়া উপস্থিত হইল। যাতনায় মোহিনীর কণ্ঠ শুকাইয়া আসিতেছিল। বেদনাতুর কণ্ঠে মোহিনী কহিল, “মা, আর সহ্য হয় না। অসীম জ্বালা। গত জীবনের এত সুখ একটুও আজ আমাকে সান্ত্বনা প্রদান করতে পারছে না। অনেক টাকা সঞ্চয় করেছি–অনন্ত সুখে সারা জীবনকে উজ্জ্বল করে রাখতে চেষ্টা করেছি। আজ–সে সব কোথায় গেল? লক্ষ যুবকের মূর্তি লক্ষ শয়তানের মতো আজ আমার সামনে ভেসে আসছে। ভগবান কি আছেন?”
মোহিনী আকুল আবেগে আবার জিজ্ঞাসা করিল–“সত্যি কি ভগবান আছে?”
সুরী দৃড়কণ্ঠে কহিল–“হ্যাঁ আছেন।”
মোহিনীর চোখে জল। সে আবার কহিতে লাগিল। ”সুরী! আট বছরের সময় বিধবা হয়েছিলাম। যখন ষোল বছর আমার বয়স তখন চোখের সম্মুখে দেখতে পেতাম–সমস্ত সংসারটায় আগুন ধরে উঠেছে। সেই আগুন নিবাতে বেরিয়ে পড়েছিলাম। ওঃ তারপর দীর্ঘ এক বিস্মৃতির যুগ কামনার আগুন যখন মুহূর্তের জন্য শান্ত হতো–ধরণীর রক্ত যখন একটু হিম হয়ে আসতো–তখন কী দারুণ মানসিক জ্বালা আমাকে পুড়িয়ে ছাই করে দিতো। বিস্মৃতির মোহিনী শক্তিকে ফিরিয়ে আনবার জন্য সুরা পান করতাম। মানবীয় সমস্ত কোমল বৃত্তিকে বলি দিবার জন্য কেবল পান করতাম সুরা। আর ফিরে যাবার জো ছিল না। আর অনুতাপ করার সময় ছিল না। সুরী, আমরা তো মানুষ, শিরায় কি রক্ত নাই? আলো ও গন্ধে ভরা পৃথিবীর বুকে ভাই-বোন একই জায়গায় বেড়ে উঠে মুহূর্তের ভুলে মেয়েমানুষকে জীবন সন্ধ্যা পর্যন্ত, অনন্তের জন্য কেন নরক বরণ করে নিতে হয়? এরা এত নিগৃহিতা কেন? এদের ফিরে যাবার আর পথ থাকে না কেন? সমস্ত সংসার এদের সামনে একটা অভেদ্য পাথরের দেওয়াল টেনে দেয় কেন? মানুষ কি পিচ্ছিল খেয়ে পড়ে না? তাই বলে কি চিরকাল তাকে কাদায় পড়ে থাকতে হবে? লম্পট, দস্যু মাতাল ভাইকে লোকে যত্ন করে তুলে নেয়, একদিনের ভুলের জন্য বোনের মাথায় তারা পাথর ছুঁড়ে মারে। সুরী, বল মা–জীবনের এই সীমাহীন পাপের জন্য কি আমি দায়ী?”
মোহিনী আবার কি বলিতে যাইতেছিল–কিন্তু একটা ভীষণ ব্যথায় সে দুমড়াইয়া পড়িল।
সুরী তাড়াতাড়ি আর এক দাগ ঔষধ মাতাকে খাওয়াইল।
মোহিনী একটু শান্ত হইয়া আবার কহিতে লাগিল–“ভগবান আমার চিন্তা নিয়ে কাজ করবেন না। যখন আমার বয়স ত্রিশ তখন সাংঘাতিক একটা আঘাত পেয়িছিলাম–সেই সময় একটা যুবককে আমি ভালবেসেছিলাম। তার মূর্তিখানি মনে হলে এখনও আমার প্রাণ স্পন্দিত হয়ে ওঠে। তার অতর্শনে প্রাণ আমার জ্বলে যেতো। জানি না, পথের রমণী হয়ে কেন তাকে ভালবাসতে গিয়েছিলাম। সুরী আমাদেরও তো প্রাণ আছে–খালি কাঠাম নিয়ে। শূন্যকে আঁকড়িয়ে ধরে কেউ বাঁচতে পারে না। আমি তো তাই পারি নাই। পরের জিনিসকে চুরি করতে গিয়েছিলাম।
তারপর কয়েকমাসের জন্য তার সঙ্গে দেখা হয় নাই। তাকে না দেখতে পেয়ে জীবনে অসহনীয় হয়ে উঠেছিল। জানতাম, তার বাড়ি গঙ্গার অপর পারে। একদিনে ঘোর অন্ধকার-প্রাণের জ্বালায় বেরিয়ে গঙ্গার বুকে ঝাঁপ দিলাম। বাঞ্ছিতকে পাবার জন্য অসীম বল এসেছিল। বিপুল বলে গঙ্গ পার হয়ে ওপারে গিয়ে উঠলাম। তার প্রকাণ্ড বাড়ি খুঁজে বের করে অনেক কষ্টে বাবুর কাছে যেয়ে তার পা জড়িয়ে ধরে বললাম”দাসীকে আর পায়ে রাখেন না কেন? পথের রমণী বলে কি ঘৃণা করেবেন?” তার পর এক সিংহীর মতো রমণী এসে অমার ঘার আর চুল ধরে বের করে দিয়ে বলেন, “পরের জিনিসের উপর তোমার এত লোভ? লজ্জা করে না?”
দারুণ লজ্জা ও ঘৃণায় ফিরে এলাম বুক ভেঙ্গে গেল। তারপর এক কাজ করেছিলাম। তা অতি ভয়ানক। সে পাপের জন্য ভগবানের কাছে আমাকে অনন্ত শাস্তি ভোগ করতে হবে।
মোহিনীর চোখ ফাটিয়া জল আসিল। আবেগে তার বুক ভাঙ্গিয়া যাইতেছিল।
মোহিনী চাপ দুর্দমনীয় উচ্ছ্বাসে আবার কহিল–“প্রাণের জ্বালা জুড়াইবার জন্য এক কাজ করেছিলাম। এরূপ পৈচাশিক কাজ আমার ছাড়া আর কেউ করতে পারে না। একটা যুবতাঁকে পথের ভিখারিণী করেছিলাম। তার অভিশাপ পলে পলে নরকের মাঝে লক্ষ সাপ হয়ে আমাকে কামড়াবে।
একদিন গঙ্গার ঘাটে যুবতী শুয়েছিল–জানি না-কি জাতি, তার বুকের শিশুকে চুরি করেছিলাম। মনে করেছিলাম, কাছে একটা শিশু পেলে প্রাণের জ্বালা কমবে। বেঁচে থাকবার সুবিধা হবে।
সুরী! সুরী! তোমাকে মা বলতে আমার সাহস হয় না। তোমার কাছে আমি অমার্জনীয় পাপ করেছি। তুমিই সেই মেয়ে। তুমি আমার গর্ভে জন্ম লও নই। তুমি ফুলের মতো পবিত্র ছিলে! তুমি দেবতার গানের মতো স্বর্গীয় ছিলে।”
সুরী লাফাইয়া উঠিল। ”আমি তোমার মেয়ে নই, আমার বাপ-মা থেকে তুমি চুরি করে এখানে এনেছ?”–বলিয়া সুরী মূৰ্ছিতা হইয়া মাটিতে পড়িয়া গেল।
১১-১৫. ইমাম বাড়ির হাসপাতালের খাতা
একাদশ পরিচ্ছেদ
”১৮–” সালের ইমাম বাড়ির হাসপাতালের খাতা খুলে দেখতে দেখতে পাওয়া যাবে একটি কলেজের ছেলের নাম।
আবু মহম্মদ আবদার রহমানের নিউমোনিয়া হয়েছিলো, চিকিৎসার জন্য কলেজ থেকে তাকে হাসপাতালে পাঠান হয়েছিল। এক মাস কেটে গেছে। একটু ভালো হয়েছে। হাসপাতালে যে দিকে মেয়েমহল তাহারই অতি নিকটে অবদার রহমানের সিট। হাসান সেখানে প্রায়ই আসেন। বন্ধুর নীরব-হাসপাতালের দিনগুলি সরস করবার জন্য হাছান বই, খবরের কাগজ প্রত্যহ দুই-তিন ঘণ্টা করে আবুর শিয়রে বসে পড়েন।