কিছুক্ষণ পরে আয়মনি নিজে থেকেই জানিয়ে দিল, দুই-বোন এখন পরদাবন্দি। বাড়ি থেকে বেরুনো বারণ। তারা যে শাদির দুলহান এখন। তাছাড়া গ্রামে কড়া পরদা চলেছে আউরতদের। সবাই ফরাজি হয়ে গেছে কিনা! আর– আয়মনি উপসংহার বলল, এখন দরিবিবির বাড়িমুখো হতে নেই তোমার তুমি যে শাদির নওশা। ওবাড়ির জামাই হবে!
হঠাৎ একটা জোরালো অভিমান আমার বুকের ভেতর চেপে বসল। সেই অভিমান সূর্য ওঠার পর আমাকে বলিয়ে দিল, আম্মা, আমি চললাম। স্কুল কামাই করলে নাম কেটে দেবে। আর আমাকে বেরিয়ে যেতে দেখে মা আর্তনাদের সুরে ডাকলেন, শফি! শফি! আমি পিছু ফিরলাম না….
০৭. ঘোড়া এবং তলোয়ার
গাজি সইদুর রহমান তাঁর দহলিজ-ঘরের উঁচু বারান্দায় আরামকেদারায় বসে স্টেটসম্যান পড়ছিলেন। আগের দিন কলকাতা থেকে তিনি বাড়ি ফিরেছেন। পাশের একটি টুলে আরো খানকতক বাসি স্টেটসম্যান রাখা আছে। সইদুর হরিণমারা তল্লাটে বড়োগাজি নামে খ্যাত। জেলাবোর্ডের মেমবার তিনি। প্রসন্নময়ী এইচ ই স্কুলের ম্যানেজিং কমিটিরও মেমবার। দক্ষিণের বারান্দায় সকালের ঝকমকে রোদ সবে টেরচা হয়ে ছুঁয়েছে। তাঁর পরনে আলিগড়ি চুস্ত পাজামা আর ঢিলেঢালা কুর্তা, পায়ে কলকাতায় কেনা লালরঙের নাগরা-ধাঁচের সুদৃশ্য চটি! বড়োগাজি শৌখিন মানুষ। তাঁর পত্নীর সংখ্যা এখন মোটে দুই এবং সেই বেগমদ্বয়ের সখি-ভাব লোকদের তাজ্জব করেছে এতকাল। ইদানীং নাকি সেই মধুর ভাবটি কোনো গোপন কারণে চটে গেছে এবং বাড়ির বাদি কুলসুম পুকুরঘাটে রটিয়েছে, বড়োগাজি ছোটোবেগমকে তালাক দেবেন। কলকাতা থেকে ফেরার পর লোকেরা সেই উত্তেজনাপ্রদ ঘটনার জন্য কান খাড়া করে আছে। শরৎকালের এই সকালে যারাই নিচের রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করছে, তারাই লক্ষ্য করে যাচ্ছে বাগাজিকে। তার মুখমণ্ডলে অবশ্য ভরাট গাম্ভীর্য। সেটা ইংরেজি পড়ার জন্য, না দাম্পত্য অশান্তিজনিত, বোঝ কঠিন।
এইসময় বড়োগাজির ভাই ছোটোগাজি মইদুর রহমান মসজিদ থেকে ফজরের নমাজ সেরে তামার প্রকাণ্ড বদনা হাতে বাড়ি ফিরছিলেন। তাঁর পরনে লুঙ্গি, শাদা থানের পিরহান, মাথায় বাবরি চুল, মুখে চাপ-চাপ দাড়ি। তিনি বড়োগাজির তুলনায় একটু বেঁটে এবং মোটাসোটা। তাঁর পায়ে স্থানীয় মুচির তৈরি কাঁচা চামড়ার তোবড়ানো জুতো। জুতোয় ধুলোকাদা এবং লুঙ্গির নিচের দিকে প্রচুর চোরকাঁটা আটকে আছে। বোঝা যায় তিনি নমাজ সেরে জমিতে-জমিতে ধানের অবস্থা দেখতে গিয়েছিলেন । তাই শিশিরে জুতো আর লুঙ্গি ভিজেছে। নোংরা হয়ে গেছে।
সিঁড়ি বেয়ে উঠে বারান্দায় ছোটোগাজি একটু দাঁড়ালেন। কিছু বলার জন্য ঠোঁট ফাঁক করলেন। সেই সময় বড়োগাজি কাগজে চোখ রেখেই বাঁকা হেসে বললেন, মদু নাকি বদুপিরের মুরিদ (শিষ্য) হয়েছে?
ছোটোগাজি চটে গেলেন। বললেন, হুঁ। হয়েছি।
বদুপির শুনেছি আসমান থেকে জিনদের ডেকে দুনিয়ায় আনে!
ছোটোগাজি ফুঁসে উঠলেন। আপনি ইংরিজি পড়েন বটে, তবে আপনার কথাবার্তা নাদান লোকের মতো। বুজুর্গ লোকের খামোখা বদনাম রটালে গোনাহ হয় জানেন না?…ছোটোগাজি উদাত্ত কণ্ঠস্বরে বলতে থাকলেন। আপনি যান। গিয়ে দেখুন হুজুর পিরসাহেবকে। তারপর বাতচিত করবেন।
বড়োগাজি হাসলেন।….আচ্ছা মদু, তুমি তো পাঁচওয়াক্ত নমাজ পড়। তোমার কপালে মুসল্লিদের ছাপ পড়েছে। তুমি বলো তো, ফরাজি যারা, তারা কেমন করে পির-টিরে বিশ্বাস করে? কেমন করেই বা তারা পির হয়? আমার কথা শোনো আগে! এই বদু মৌলানা শুনেছি খয়রাডাঙায় পিরের থান ভেঙে এসেছে। সে নিয়ে এক তুলকালাম হয়েছে। ওকে শেষ অব্দি খয়রাডাঙা থেকে পালিয়ে আসতে হয়েছে। আর সেই বদমৌলানা নিজেই পির সেজে বসল! তোমাদের মতো কতকগুলো বুড়বক গিয়ে তার পাগড়ি ধরে মুরিদ হলে!
ছোটোগাজি খাপ্পা হয়ে দলিজঘরের ভেতর দিয়ে অন্দরে ঢুকে গেলেন।
ঠিক এই সময় দুটি ছেলে রাস্তা দিয়ে আসতে-আসতে থমকে দাঁড়িয়ে কথা শুনছিল। চোখ পড়ায় বড়োগাজি জিগ্যেস করলেন, কে রে তোরা?
রবি আদাব দিয়ে বলল, আমি রবিউদ্দিন, চাচাজি!
অ। আর ওটা?
রবি কাঁচুমাচু একটু হেসে বলল, এ শফি! মৌলাহাটের পিরসাহেবের ছেলে।
বড়োগাজি সোজা হয়ে বসলেন। তারপর হো-হো করে অট্টহাসি হাসলেন।… শুনে ফেললে নাকি গো ছেলে? তোমারই আব্বার নিন্দে করছিলাম আমার আবার বড্ড বেফাঁস কথাবার্তা বলার হ্যাবিট আছে। রবিকে জিগ্যেস করো। না কী রে, রবি?
রবি শুধু খিকখিক করে হাসতে লাগল। শফি চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল।
বড়োগাজি ডাকলেন, কী নাম গো তোমার? ও রবি, কী নাম, বললি যেন?
রবি বলল, শফিউজ্জামান।
ও এখানে কী করে?
আমার সঙ্গে পড়ে স্কুলে। আমাদের বাড়ি ‘জায়গির’ আছে।
ভেরি ওয়েল! কাম অন বয়, কাম হেয়ার! বড়োগাজি হাত তুলে ডাকলেন শফিকে।
কিন্তু শফি গোঁ ধরে দাঁড়িয়ে রইল। রবি তাকে ফিসফিস করে বলল, বড়োগাজি! মস্ত লোক। চল না! তবু শফি গেল না।
বড়োগাজি হাসতে হাসতে বললেন, অলরাইট! বলো তো– আমার একটি ঘোড়া আছে ইংরেজি কী? বলল –দেখি তুমি পিরসাহেবের ছেলে হয়ে কেমন লেখাপড়া শিখেছ। বলল, আমার একটি ঘোড়া আছে।
শফি আস্তে বলল, মাই..মাই হ্যাজ এ…হ…হ–
তুমুল অট্টহাসি হেসে বড়োগাজি বললেন, এ কী রে রবি? পিরসাহেবের ছেলে এ কী ইংরেজি শিখেছে! মাই হ্যাজ হয় না –আই হ্যাভ। আমার একটা ঘোড়া আছে –আই হ্যাভ এ হর্স। শোনো গো পিরসাহেবের ছেলে, আমার কাছে রোজ সকালে এসো। ইংরেজি পড়াব। রবি, ওকে নিয়ে আসিস। তুইও পড়বি। মরনিংয়ে আমি ফ্রি থাকি ।…