- বইয়ের নামঃ কর্নেলের গল্প
- লেখকের নামঃ সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ
- বিভাগসমূহঃগল্পের বই, কর্নেল সমগ্র
কালো পাথর
০১.
প্রেতাত্মা নিয়ে আসর বসানো অরুণেন্দুর হবি। এই আসরে মৃত মানুষের আত্মার আবির্ভাব হয় কোনো জীবিত মানুষের মাধ্যমে, যাকে বলা হয় মিডিয়াম। অরুণেন্দু নিজে কিন্তু মিডিয়াম নয়, নিছক উদ্যোক্তা। মিডিয়াম সবাই হতে পারে না। অরুণেন্দুর মতে সূক্ষ্মাতি সূক্ষ্ম ইন্দ্রিয়ের অধিকারী এবং খুব অনুভূতিপ্রবণ মানুষই মিডিয়াম হবার যোগ্য। পুরুষের তুলনায় এ ক্ষমতাটি মেয়েদের বেশি। তাই মেয়েদের মধ্যেই সে মিডিয়াম খোঁজে। পেয়েও যায়। অশরীরী আত্মা আনতে দেরি করে না। অরুণেন্দু দাবি করে, শতকরা নব্বইটি আসরে তার সাফল্যের অভিজ্ঞতা হয়েছে। এই আসরকে ইংরেজীতে বলা হয় Seance-এর আসর। ..
আসর যখন তখন যেখানে বসানো যায় না। পরিবেশ নির্জন এবং স্তব্ধ হওয়া চাই। আসরের লোকগুলোরও বিশ্বাস থাকা চাই দেহাতীত সত্তায়। তবে আত্মার আবির্ভাবের গ্যারান্টি দিতে অরুণেন্দু রাজি, যদি প্রাকৃতিক দুর্যোগের রাতে কোনো নিরিবিলি বাড়িতে আসর বসানো যায়।
সেদিন এই রকম একটা অবস্থা দেখা দিয়েছিল চব্বিশে অক্টোবর রাত দশটায়, বঙ্গ-বিহার সীমান্তে খনি এলাকায় বারাহিয়া টাউনশিপে, ডঃ কুসুমবিহারী রায়ের বাড়িতে। ডঃ রায় খনি ও ধাতুবিশেষজ্ঞ সরকারি অফিসার। অরুণেন্দু সম্পর্কে তার ভাগ্নে। যখনই বেড়াতে আসে, প্রেততত্ব নিয়ে বকবক করে সারাক্ষণ।
রাতের খাওয়ার পর বাইরের বারান্দায় বসে গল্প করছিলেন ডঃ রায়, তার স্ত্রী মীনাক্ষী, একমাত্র সন্তান মঞ্জুশ্রী, তার হবু বর সুমন আর অরুণেন্দু। সেই সময় হঠাৎ বজ্রবিদ্যুৎসহ ঝড়বৃষ্টি এসে গেল। তার মধ্যে লনের ওধারে গেট খুলে দৌড়ে এল দুটি মেয়ে, অনুরাধা আর ভাবনা দুই বন্ধু। মঞ্জুশ্রীরও বন্ধু। বেড়াতে বেরিয়ে আচমকা প্রকৃতির তাড়া খেয়ে আশ্রয় নিতে এল।
ভাবনা গুজরাটি মেয়ে। তার বাবা কেশবলাল শান্তপ্রসাদ স্থানীয় ব্যবসায়ী। ভাবনার জন্ম বারাহিয়ায়। তাই সে বাংলাও বলে মাতৃভাষার মতো।
বৃষ্টির ছাঁট এসে সবাইকে বিব্রত করছিল। তাই ডাইনিং-কাম-ড্রয়িংরুমে যাওয়া হল। অনুরাধা ও ভাবনা যে-যার বাড়িতে ফোনে জানিয়ে দিল মঞ্জুশ্রীদের বাড়িতে আটকে পড়েছে। চিন্তার কারণ নেই। ডঃ রায় গাড়ি করে পৌঁছে দেবেন তাদের।
কফির আসর বসল এবার। অরুণেন্দু কিছুক্ষণ আগে সিয়াস (Seance) নিয়ে আলোচনা করছিল। ডঃ রায় ওসব বিশ্বাস করেন না। কিন্তু মা ও মেয়ে করে। তারা মুগ্ধ হয়ে শুনছিল। সুমন হা বা না কিছুই বলছিল না। সে বরাবর মধ্যপন্থী সব ব্যাপারে। কফির আসরে আরও দুজনকে পেয়ে অরুণেন্দু আগের কথাটার জের টেনে আনল। অনুরাধা ও ভাবনার চোখে ফুটে উঠল চাপা ভয় ও বিস্ময়। বাইরে ঝড় বৃষ্টি, মেঘের গর্জন যেন অশরীরী আত্মারা আত্মপ্রকাশের জন্য অস্থির হয়ে, জীবিত মানুষের আনাচেকানাচে ছোঁক ছোঁক করে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
মঞ্জুশ্রী বলল, তাহলে অরুদা, এই তো তোমার মতে উপযুক্ত সময়।
তার মা মীনাক্ষী হাসতে হাসতে বললেন, খুব হয়েছে, আত্মাটাত্মা ডেকে, এখন কাজ নেই। মুখেই বলল অরু, শুনতে বেশ লাগছে।
ভাবনা একটু হাসল হঠাৎ। না মাসিমা। আমরা পরীক্ষা করে দেখি না, যদি সত্যি আত্মা আসে।
ডঃ রায় হাই তুলে বললেন, ও কে! তোমরা আজ্ঞা দাও। আমি একটু পড়াশোনায় বসি এবার। অনু, ভাবনা-চিন্তা কোরো না। পৌঁছে দেবখন, যত রাতই হোক।
তার পেছন-পেছন মীনাক্ষীও চলে গেলেন। ছেলেমেয়েদের মধ্যে আর আড্ডা দেওয়া শোভন নয়। ওরা হয়তো মন খুলে কথা বলতে পারছে না। বিশেষ করে। সুমন ও মঞ্জুশ্রীর কথা ভেবেই উঠে গেলেন মীনাক্ষী।
সুমন চোখ নাচিয়ে বলল, কী অরুদা, হবে নাকি?
অরুণেন্দু পা বাড়িয়েই ছিল। অনুরাধার দিকে তাকিয়ে বলল, আপনার আপত্তি নেই তো?
অনুরাধা আস্তে মাথাটা দোলাল।
অরুণেন্দু তার দিকে তাকিয়েই রইল মিনিট-খানেক। তারপর রহস্যময় হেসে বলল, আমার বিশ্বাস, মিডিয়াম, হবার যোগ্যতা এখানে একমাত্র আপনারই আছে।
ভাবনা বলল, কি করে বুঝলেন বলুন তো?
অরুণেন্দু বলল, ওটা আমার ইনটুইশান বলতে পারেন। দশবছর ধরে এসব নিয়ে আছি। দেখামাত্র বুঝতে পারি কে ভাল মিডিয়াম হতে পারে। অনুরাধা প্লিজ আপত্তি করবেন না কিন্তু।
অনুরাধা মৃদুস্বরে বলল, আমাকে কী করতে হবে?
অরুণেন্দু উঠে দাঁড়িয়ে বল্ল, ডাইনিং টেবিলে চলুন সবাই বলছি। আর মঞ্জু একটা হাল্কা পেন্সিল আর একটা কাগজ চাই। ঝটপট! সময় চলে যাচ্ছে। আর একটা মোম চাই।
সঙ্গে সঙ্গে জোগাড় হয়ে গেল। কিচেন বন্ধ করে ফেলু ঠাকুর আর পরিচারিকা সুশীলাকে নিজেদের ঘরে পাঠানো হল। দরজা ও জানালাগুলো বন্ধ করে, অরুণেন্দু মোমবাতি জ্বেলে টেবিলে রাখল। বাইরের প্রাকৃতিক আলোড়ন খুব চাপা শোনাচ্ছিল এবার। ফ্যান বন্ধ করলে ঘরের ভেতরটা গুমোট হয়ে উঠল। কিন্তু উপায় নেই।
সে অনুরাধাকে টেবিলের একদিকে একা বসাল। অন্যদিকে পাশাপাশি বসল সুমন, ভাবনা, মঞ্জুশ্রী আর সে। অনুরাধার হাতে পেন্সিল ও কাগজটা দিয়ে সে বলল, পেন্সিলটা কাগজের ওপর আলতো ভাবে রাখুন। তারপর কী করতে হবে বলছি।
অরুণেন্দু খুব চাপা গলায় বলতে থাকল, এবার আমরা সবাই মিলে এমন একজন মৃত মানুষের কথা, চিন্তা করব, যাকে আমরা প্রত্যেকে চিনি। চিনি মানে ব্যক্তিগতভাবে না চিনলেও পরোক্ষ ভাবে চিনি। অর্থাৎ জানি। যেমন রবীন্দ্রনাথ। আমি টেবিলে সংকেত করব। সঙ্গে সঙ্গে গভীর মনোযোগে রবীন্দ্রনাথের কথা চিন্তা করতে হবে। অনুরাধা আমাদের আসরের মিডিয়াম। রবীন্দ্রনাথের আত্মা তার মধ্যে আসবেন। অনুরাধা, প্লিজ বি ভেরি কেয়ারফুল। তিনি এলে আপনার পেন্সিল কেঁপে উঠবে কিংবা অন্য কোনো ভবে টের প্রানে সেটা। আপনার আঙুল যদি লিখতে চায় জোর করে বাধা দেবেন না কিন্তু। এটা একটা সিরিয়াস এবং কঠিন ব্যাপার-মানে, আপনার সচেতন মন অন্যের অনুভূতি-চিন্তা কাজকে বাধা দিতে চাইবে। আপনি নিষ্ক্রিয় থাকার চেষ্টা করবেন। মনে রাখবেন, আপনার এই মানসিক অবস্থার ওপর আসরের সাফল্য নির্ভর করছে। কেমন?