- বইয়ের নামঃ কাগজে রক্তের দাগ
- লেখকের নামঃ সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ
- প্রকাশনাঃ দে’জ পাবলিশিং (ভারত)
- বিভাগসমূহঃগল্পের বই, কর্নেল সমগ্র
১. মেয়েটি বারে গান গাইত
মেয়েটি বারে গান গাইত। হাতের মুঠোয় স্পিকার। হাল্কা-পলকা মেয়েটি ফুলের ওজন। গলায় স্টার গায়িকার প্রতিধ্বনি। বারটিও ছিল ছোট্ট। ছিমছাম, রঙচঙে, গোছানো। মিঠে, নরম আলোয় সিগারেটের ধোঁয়া কুয়াশার মতো দুলত। এখানে যারা আসত, তারা কেউ জাত-মাতাল নয়। নেহাত পাতি, ছিচকে। কোনও মাঝারি কারবারি কি তার তরুণ প্রজন্ম। দৈবাৎ কোনও একলা হয়ে-পড়া বুড়ো। একঝক ছাত্র কি কোন পাড়ার মস্তান। কদাচিৎ একরোখা প্রেমিকের টানে কোনও এরিয়া প্রেমিকা, এক চুমুকের পরই যাকে সামলানো কঠিন হতো প্রেমিকের। একলা বুড়ো মাতাল কোনার দিকে বসে আপন মনে শব্দহীন হাসত।
ছোট্ট ডায়াসে বাজত স্প্যানিস গিটার, অ্যাকর্ডিয়ান, জিপসিদের ঝুমঝুমি। মেয়েটি একটু নাচের ভঙ্গি করত। জমাটির সময় শোনা যেত মাতালদের তীক্ষ্ণ শিস, হুই, হই। তবে সামলানোর জন্য একটি লোক ছিল। তাগড়াই ): না। মস্ত গোঁফ। নতুন মাতাল বেগড়বাই করলে সে ইঁদুরছানার মতো তুলে ফুটপাতে ফেলে দিত।
রাত দশটায় মেয়েটিকে নিতে আসত তার বাবা। সত্যিই কি বাবা? বার মালিকের সন্দেহ ছিল। কিন্তু কে কার বাবা, এ নিয়ে তার মাথা ঘামানোর মানে হয় না। কম টাকায় তিন ঘণ্টার গান, এই তো যথেষ্ট। সে জানত, তাকে মানুষদের গার্জেনগিরি ফলাতে দেওয়া হয়নি। সে কোনও মরালিটির জিম্মাদার নয়। রাষ্ট্র তাকে নাগরিকদের মাতাল করার অধিকার দিয়েছে। মদ খাওয়া ইমমরাল হলে যত বেশি ইমমরালিটি ছড়ায়, তত তার লাভ। তবে মদ খাওয়া সে ইমমরাল মনে করে না। যত দিন যাচ্ছে, সমস্যা বাড়ছে। মানুষজন যদি কিছুক্ষণ সমস্যা ভুলে থাকতে চায়, মন্দ কী? মদের সঙ্গে অপরাধের কোনও সম্পর্ক নেই, এই তার শক্ত লজিক। ওই গাইয়ে মেয়েটি যদি খারাপ হয়ে যায়, তার সঙ্গেও এই বারের সম্পর্ক সে স্বীকার করে না। কারণ বারে গান করে না, এমন মেয়েরাও তো খারাপ হয়ে যায়।
মেয়েটি বুঝতে পারছিল, বারের মালিক তাকে কম টাকা দেয়। সে নিজের দামও বুঝতে পারছিল। তাই অনেক সেধে ইদানীং যাতায়াতের ট্যাক্সিভাড়াও আদায় করত। দৈত্যের মতো দেখতে সেই প্রহরী যাওয়ার সময় ট্যাক্সি ধরে দিত। হাত নেড়ে বলত, যাই।
মেয়েটি থাকত এঁদো শহরতলিতে। টালির বাড়িগুলো ছিল অসম্বন্ধ, ঘন। তার ভেতর জরাজীর্ণ একতলা কিছু দালান। একটু দূরে ভাঙা গির্জা আর কবরখানা। তারপর রেলইয়ার্ড। মেয়েটি থাকত একটা দালানে। কার্নিশে অশ্বথচারা, দেয়ালের বাইরে ফাটল, নগ্ন ইট। মেয়েটি ভেতরটা সাজিয়ে গুছিয়ে সুন্দর করতে পেরেছিল।
আর বার-মালিক ঠিকই ধরেছিল, প্রৌঢ় ঢ্যাঙা লোকটি তার বাবা নয়। সে তার বাবার এক বন্ধু। ইলেকট্রিক মিস্ত্রি। পাশের ঘরের ভাড়াটে। মেয়েটির পরিবারে ছিল শুধু তার মা। মায়ের অনুরোধেই মিস্ত্রি লোকটি এসকর্ট হতো এবং পাঁচটা করে টাকা পেত। মন্দ কী!
এমন এক মেয়ে, তার প্রেমিক থাকবে না, তা হয় না। বস্তি এলাকার সব উঠতি তরুণ তার কাছে প্রেম দাবি করত। তারা জানতে পেরেছিল, মেয়েটি বারে গান গাইতে যায়। প্রেম না পেয়ে তারা কেউ কেউ টাকা ধার চাইত অর্থাৎ দাবি করত। মেয়েটি স্বপ্ন দেখত, সে একদিন উঠে যাবে ভদ্র এলাকার কোনও ফ্ল্যাটে। আয়নায় নিজেকে সে দেখত উজ্জ্বল সুন্দর। মুগ্ধ হয়ে ভাবত, তাকে এখানে মানায় না। কেন সে এখানে পড়ে আছে? আর কতকাল তাকে এই আবর্জনার গাদায় পচে মরতে হবে? বার-মালিক জানে না, সে যে-সব গান গায়, তা আসলে তার নিজস্ব প্রার্থনা! যে পরিচ্ছন্ন, শোভন, পেলব স্তরে সে পৌঁছতে চায়, ওইসব গান দিয়ে সেই স্তরকে সে ছুঁত। আর গান জিনিসটাও তত জীবনের ওইরকম একটা দিকে টুকরো-টাকরা অংশ।
আবার জীবনেরই আরও একটা দিক আছে। সেই দিকেরও টুকরো-টাকরা অংশ আছে, যা কুর, ভয়াল। ভুল পা ফেলে দৈবাৎ সেখানে পৌঁছুলেই সর্বনাশ। জীবনটা মৃত্যু হয়ে যায়।
মেয়েটি সেই ভুল করে বসল। তার মৃত্যু হলো। ক্রুর ভয়াল মৃত্যু। প্রচুর রক্তে সবুজ ঘাস লাল হয়ে গেল!……….
.
০১.
কর্নেল নীলাদ্রি সরকার কাগজটির ওপর আতস কাচ রেখে হরফগুলো দেখতে দেখতে বললেন, প্রত্যেকটি শব্দ যত্ন করে লেখা। বাছাই করা শব্দ। বাক্যগুলোর মধ্যে ছন্দ আছে। একসময় হয়তো কবিতা লেখার অভ্যাসও ছিল। ডার্লিং! এই লেখাটির লেখক খাঁটি দার্শনিক।
ডিটেকটিভ ডিপার্টের ডেপুটি কমিশনার অরিজিৎ লাহিড়ী হাসলেন। আপনার দর্শন-টশনে আগ্রহ আছে, জানি। বাট দিজ ইজ আ মার্ডার!…
কোনও-কোনও মার্ডারে দার্শনিকতা থাকে, অরিজিৎ! কর্নেল টেবিলে কাগজটির ওপর আতস কাচ চাপা দিয়ে বললেন। মুখে গাম্ভীর্য। যাই হোক, এই কাগজটা কোথায় পেলে?
গৌরীর ব্লাউসের ভেতর রাখা পার্সে! তাই বৃষ্টিতে ভেজেনি।
গৌরী?
মেয়েটির নাম। নিক নেম টিনি। বস্তি এরিয়ায় টিনি নামেই ওকে সবাই জানত।
কর্নেল সাদা দাড়িতে হাত বুলিয়ে বললেন, বডি কী অবস্থায় ছিল?
উপুড় হয়ে। একটা হাত কবরের ওপর। কবরটা ব্রিটিশ আমলের। ক্রসটা ভাঙা। ক্রসে এবং কবরে রক্তের আভাস আছে। বৃষ্টি হলেও বোঝা যায়।