- বইয়ের নামঃ হাঙর নদী গ্রেনেড
- লেখকের নামঃ সেলিনা হোসেন
- প্রকাশনাঃ অনন্যা
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
০১. বারো ভাই-বোনের সবচেয়ে ছোট
বারো ভাই-বোনের সবচেয়ে ছোট বলে বাবা আদর করে নাম রেখেছিল বুড়ি। অবশ্য আদর করে কিনা কে জানে! বুদ্ধি হবার পর থেকেই জেনে এসেছে ওর নাম বুড়ি। নামটা ওর পছন্দ হয়নি। শুনলেই শরীর চিড়বিড়িয়ে ওঠে। ওর ধারণা নাম খুব সুন্দর হওয়া চাই। যেটা শুনলে মন খুশিতে নেচে ওঠে। সাড়া দিতে ভালোলাগে। সেজন্যে বাবার কাছে গিয়ে নাম বদলে দেবার জন্যে অনেক কাদাকাটি করেছে। কিন্তু লাভ হয়নি। বাবা ওর কথা কানেই তোলেনি। খেলার সাথীদের কাছে আবেদন করেছিল, তোরা আমাকে বুড়ি বলে ডাকবি না।
ওরা প্রবলভাবে আপত্তি করে, না, তুই বুড়ি। বুড়ি। বুড়ি।
ওরা এ নামে ডেকেই আমোদ পায়। ওকে খেপানো যায়।
ফলে বুড়ি বুড়িই রয়ে গেলো। একটা পছন্দহীন নাম নিয়ে দিন কাটাতে হয়। ঘন সবুজ কচুপাতার মতো বুড়ির মন। সে পাতায় জলের দাগ পড়ে না। হৃদয়ের সূক্ষ্ম অনুভূতি ওকে আক্রান্ত করে না, বুড়ি নির্বিবাদে সে বেড়ি পেরিয়ে আসে।
হলদী গাঁয়ের এ বাড়ি ছেড়ে আর কোথাও যাবার সুযোগ হয়নি ওর। পশ্চিমে স্টেশনে যাবার বড় রাস্তা। পুবে খালের ধার। উত্তর-দক্ষিণে মাঠের পর মাঠ। এর বাইরে কি আছে বুড়ি জানে না। আশপাশের ঘরের ছেলেমেয়েরা দাদার বাড়ি, নানার বাড়ি যায়। বুড়ির তাও যাওয়া হয়নি। বাবার কাছে কিংবা মার কাছে বায়না ধরে লাভ নেই। উল্টো বকা খেতে হয়। সংসারের ঝামেলায় মা কোথাও বেরুতে পারে না। বাবা কাউকে সঙ্গে নিয়ে কোথাও যায় না। বুড়ি ভীষণ নিঃসঙ্গ। একদল ভাই-বোনের মধ্যে থেকেও বুড়ির মন কেমন করে। সে মনের কথা কেউ বোঝে না। বুঝতে চায় না। যে মনের ডানা অনবরত রঙ বদলায় তাকে বুঝবে কে? খেলতে খেলতে খেলা ছেড়ে ঘরে এসে চুপচাপ বসে থাকে। ওরা ডাকতে এলে রাগ করে। কখনো গালি দেয়। অকারণে ঝগড়া বাধিয়ে তোলে। তারপর একসময় খালের ধারে গিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। বাতাসে থিরথির জল কাঁপে। পানির ওপর মাথা উঁচিয়ে থাকা সবুজ ঘাসের ডগায় কাচপোকা উড়ে বেড়ায়। বুড়ি ঘোলা জলে নিজের মুখ দেখার চেষ্টা করে। কিন্তু দেখা হয় না। আহা জলের স্পর্শে কী ভীষণ সুখ।
একদিন দুরন্ত কৌতূহলে জলিলের সঙ্গে স্টেশনে গিয়েছিল। বুড়ির জিজ্ঞাসু মনের কাছে স্টেশন মানেই রূপকথার জগৎ। সেখানকার কোনো কিছুই ও চেনে না। অথচ চিনে নেবার জন্যে আগ্রহের শেষ নেই। ওরা স্টেশনে পৌছার সঙ্গে সঙ্গে মেল ট্রেন ঝড়ের গতিতে পার হয়ে গেলো। অত ছোট স্টেশনে মেল ট্রেন দাঁড়ায় না। বুড়ির বুকের ধুকধুকানি বেড়ে যায়। উত্তেজনায় জলিলের হাত আঁকড়ে ধরে। রেলটা শেষ বিন্দু হয়ে মিলিয়ে যাবার পরও ঝঝকে লাইনের ওপর দাঁড়িয়ে ছিল বুড়ি। বুক ভরে শ্বাস নিয়েছিল। কেমন একটা অচেনা গন্ধ ওকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল।
–গাড়িটা কোথায় যায় রে জলিল?
–অনেক দূর।
–অনেক দূর, কত দূর?
–আর্মিও কি জানি ছাই! একদিন উঠে টুস করে চলে যাব কোথাও। আর ফিরব না।
জলিল চোখ বড় করে বলেছিল—
–আমারও যেতে ইচ্ছে করে। তুই আমাকে নিবি?
–ইশ শখ কতো? তুই আমাকে নিবি? ভাগ।
জলিল ওকে ভেংচি কাটে।
বুড়ির মন খারাপ হয়ে যায়। তবুও আপন মনে বলে, আমিও একদিন কোথাও চলে যাব। কেঁচড় ভর্তি নুড়ি নিয়ে ফিরে এসেছিল সেদিন। জলিল স্টেশন মাস্টারের ঘরের সামনে ঘুরঘুর করছিল বারবার। ট্রেনে চড়ার মতলবে ছিল ও। সুযোগ করে। একদিন ও ঠিকই উঠবে। কিন্তু বুড়ি কিছুই করতে পারে না। মনের মধ্যে হাজারটা ইচ্ছে থাকলেই কি আর সব করা যায়? মেইল ট্রেন আকাঙ্ক্ষার পাখি হয়ে উড়ে চলে যায় একদম বুড়ির নাগালের বাইরে। হলদী গার বাইরের দুনিয়াটা দেখার সাধ্যি বুড়ির। নেই। কিন্তু বড় বিশ্রী এই মনটা। কোন বাধা মানে না, ছুটে চলে যায় দূর-দূরান্তে। সেদিন জলিল ফেরেনি ওর সঙ্গে। ও অন্য কোথায় যেন চলে গিয়েছিল। একা একা ফিরেছিল বুড়ি। কোচড় ভর্তি পাথরের নুড়ি গায়ে লেগে শব্দ করছিল। ভাল লাগছিল না ওর। তৃষ্ণার্ত মনটা বাগ মানাতে না পেরে নুড়িগুলো এলোপাথাড়ি ছুঁড়ে মেরেছিল সারাপথ। লজ্জাবতীর ঝোপে লাথি দিয়ে ব্যথা পেয়েছিল। তবুও ওতেই ছিল আনন্দ। মন খারাপের আনন্দ। ট্রেনের ঐ ঝিকঝিক্ শব্দ বুড়িকে অনেকদিন নেশাগ্রস্ত করে রেখেছিল। বুকের তল থেকে ঐ শব্দ কেবলই ঘুম ভাঙিয়ে দিত। অন্ধকারে চোখ মেলে রেখে বুড়ির রাত শেষ হয়ে যেতো। এর বেশি কিইবা করতে পারে ও। বুড়ির মন বিগড়ে যাওয়া ইঞ্জিনের মতো থমকে থাকে। কেবলই জানতে ইচ্ছে করে খাল কোথায় শেষ হয়। পথ কোথায় ফুরিয়ে যায়। আর তখনই কেমন বিচ্ছিন্ন ভাবনায় বুক মোচড়ায়। মনটা জল থৈ থৈ ঝিলের মতো ছপছপ করে।
হলদী গাঁর ছোট পরিসরে বুড়ি একটু বেশি এগিয়ে গিয়েছিল। সমবয়সী খেলার সাথীরা যেমন ওর নাগাল পেতো না, ওকে বুঝতে গিয়ে হিমশিম খেত–তেমন বড়রাও ওকে কাছে টানতে পারেনি। মায়ের ডাকে ভুল করেও সাড়া দিতে চাইতো না ও। মা মানেই হেঁসেল আর এটা আনো ওটা আনো-র ফাইফরমাস খাটা। তার চাইতে খালের ধার ভাললা, জামরুল গাছের তলা ভালো। আর এ জন্যেই মার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো ও। বুড়ি কারো জন্যে কোনো বন্ধন অনুভব করে না। কোনদিন। ভাত খেতে ডেকে না পেয়ে মা রেগে গগ করতো, এমন ছিষ্টিছাড়া মেয়ে বাপের জন্মেও দেখিনি বাবা! ওর যে কি হবে?