মনের কথা। অহরহ নিজের ভেতরে গুমরে মরে। গফুর সন্তানের জন্য খুব বেশি উচ্চবাচ্য করে না। ছেলেতো রয়েছে। আর না হলেই বা কি? এইতো ভালো আছে বুড়ি, কেমন নির্ঝাঞ্ঝাট। যখন যা খুশি তখন তা করতে পারে। দিনে রাতে অনেক কাছে পাওয়া যায় ওকে। হুটোপুটি মাতামাতিতে কোনো বাধা নেই। আসলে গফুর চায় না যে। বুড়ি অন্য কোথাও বাঁধা পড়ুক। ও আর কিছু নিয়ে নিজেকে ব্যস্ত রাখুক। তাছাড়া একটা বাচ্চার ঝক্কি কি কম! ধুত! দরকার নেই। বুড়ি গফুরের একলার। আর কারো নয়। কিন্তু গফুর যাই ভাবুক না কেনো বুড়ির দিন আর কাটতে চায় না। দিন দিন নিজের মনে কুঁকড়ে যেতে থাকে। এখন বাইরে যেতেও ভালোলাগে না। ঘরেতো মন বসেই না। এখন অন্য কিছু চাই। চারটি বছরের আনন্দ উত্তেজনা বুড়ির জীবনে বোঝা হয়ে চেপে বসে। গফুর ওকে সান্ত্বনা দেয়।
–তুই এত ব্যস্ত হয়েছিস কেনো বুড়ি? ছেলেতো আমাদের রয়েছে? ওরা কি তোকে সুখ দেয় না?
–দেয় কিন্তু তেমন করে দেয় না। মাঝে মাঝে মনে হয় ওরা আমার কেউ না। এবার আমার নিজের চাই। নাড়িছেঁড়া ধন চাই! আমার শরীরের ভেতর উথাল পাথাল চাই! আমার–আমার–
বুড়ি আর কিছু বলতে পারে না, মুখে কথা আটকে যায়। কেমন করে গফুরকে বোঝাবে? গফুর পুরুষ। সন্তানের উপলব্ধি এত নিবিড় করে ও কোথায় পাবে? সেজন্য মাঝ পথে বুড়ির কথা থেমে যায়, বুকের দরজা বন্ধ করে ফেলে।
বুড়ির মুখ করুণ দেখায়। সেই বাঁধ-ভাঙা হাসি কমে গেছে। চেহারার দীপ্তিময় লাবণ্যে ছায়া পড়েছে। বুড়ি আর আগের মতো নেই। বদলে যাচ্ছে। এ পরিবর্তন গফুরকে কষ্ট দেয়। কিছু করতে না পারার অক্ষমতায় চুপসে থাকে। ভোররাতে একা একা জাল নিয়ে বেরুলে গফুর সেই উচ্ছ্বাস ফিরে পায় না। যাকে কেন্দ্র করে ওর পঁয়তাল্লিশ বছরের জীবন অর্থবহ হয়ে উঠেছিল। কখনো কাছে বসিয়ে বুড়িকে আদর করে সান্ত্বনা দেয়।
–ছেলের জন্যে অনেক কষ্ট সইতে হয় বুড়ি?
–জানি। কষ্ট না সইলে বুঝব কি করে মা হওয়ার কি জ্বালা। আমার আর কিইবা করার আছে? দুবেলা রাধাবাড়া, খাওয়া-দাওয়া, ধান সেদ্ধ, হাঁস-মুরগির খোয়াড় খোলা? না আমার আরো কিছু চাই। ছেলে-পুলে না হলে আমি নদীতে ডুবে মরবো?
বুড়ি ফিকে হাসে। গফুর চুপচাপ বসে থাকে। এর বাইরে ওকে আর কিছু বলা যায় না। ও এখন যন্ত্রণা চায়। যন্ত্রণার ভেতর থেকে নিংড়ে আনতে চায় পরিশুদ্ধ আনন্দের ফুল। নইলে জীবন ব্যর্থ। আশা-আকাঙ্ক্ষা ঐ এক জায়গায় এসে থেমে গেছে। এমনকি গফুরকেও একপাশে ঠেলে রেখেছে। বুড়ি এখন আর কিছু বুঝে উঠতে চাইছে না। মা হওয়া ওর একান্ত দরকার।
মাঝে মাঝে পড়শিরা খোঁচা দেয়।
অমন ধিঙ্গি মেয়ে ধেই ধেই করে মাঠেঘাটে ঘুরে বেড়ালে পোলাপান হয় নাকি? হাওয়া বাতাস বলে একটা জিনিস আছে না? বেলা অবেলা আছে না? মেয়ে মানুষের সব সময় সব জায়গায় যাওয়া ঠিক নাকি?
বুড়োদের মুখ ঝামটা খেয়ে বুড়ি চুপ করে থাকে। হাওয়া বাতাস, বেলা অবেলা যত কিছুই ওরা বলুক না কেন তার সঙ্গে মা হওয়ার কি সম্পর্ক বুড়ি বুঝতে পারে না। তবু কথা বাড়াতে সাহস হয় না। অনেক কিছুই তো ও জানে না। হয়তো গৃঢ় কোন কিছু থাকতে পারে। এ নিয়ে বাড়াবাড়ি না করাই ভালো। ও এখন বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলায় আবর্তিত। কিছুদিন আগে হলেও যেটা সে হেসে উড়িয়ে দিতে পারতো, এখন কীসের যেন ভয়। যদি ওর অবিশ্বাসে ক্ষতি হয়? যদি আকাক্সিক্ষত ফল লাভ না হয়? বুড়ি তাই মনেপ্রাণে মুরুব্বিদের কথা মেনে চলার চেষ্টা করে।
শুরু হয় গ্রামের টোটকা ওষুধের ব্যবহার। যত রকমের যত কিছু থাকতে পারে কোনটাই বাদ দেয় না। যে যা বলে বিনাদ্বিধায় তা বিশ্বাস করে এবং খুব নিষ্ঠার সঙ্গে তা পালন করে। আরো দুটা বৎসর কেটে যায়। প্রহর গোনা শেষ হয় না। আকাঙ্ক্ষাতেও ভাটা পড়ে না। বরং তা আরো তীব্র হয়ে ওঠে। আজকাল সলীম, কলীম যখন মা, মা বলে আবদার করে তখন মাঝে মাঝে কেমন বিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে থাকে। ঐ শব্দটা ওকে একদম বিহবল করে ফেলে। তারপর বুকে জড়িয়ে ধরে পাগলের মতো আদর করে। কোন দিন এক ঝটকায় দূরে ফেলে দিয়ে চুপচাপ পুকুরঘাটে গিয়ে বসে থাকে। জলের বুকে মাছের ফুটকি কাটা দেখে। নিজের অস্থিরতা কমানোর চেষ্টা করে, নিজের আচরণের জন্যে লজ্জা পায়। সলীম লীমের মলিন মুখের কথা মনে করে ওর কষ্ট হয়। তবুও নিজের সঙ্গে আপস করতে পারে না বুড়ি, বুকে আকণ্ঠ পিপাসা।
মনোবিকলনের এমনি মুহূর্তে একদিন দক্ষিণ পাড়ায় বেড়াতে এলো ওর ছোটবেলার সই নমিতা। অন্যগাঁয়ে বিয়ে হয়ে যাওয়াতে ওর সঙ্গে খুব কমই দেখা হয়। বুড়ির। অনেকদিন পর নমিতাকে দেখে বুড়ির আনন্দের সীমা নেই। দুজনে পানের বাটা সামনে নিয়ে পা বিছিয়ে গল্প করতে বসে।
একথা সেকথার পর নমিতাই বলে, তোর যেন কি হয়েছে বুড়ি।
–কৈ কিছু না তো?
–তুই আর আগের মতো নেই।
–বয়স হচ্ছে তো। বুড়ি আর কথা বলতে পারে না। নমিতাও চুপ থাকে।
–তোর ছেলে পুলে কটি নমিতা?।
–আটটি। এক দঙ্গল ছেলেপুলে নিয়ে সারাদিনে একটুও সময় পাই না। তুই বেশ নির্ঝাঞ্ঝাট আছিস।
–আমি নির্ঝাঞ্ঝাট থাকতে চাই না নমিতা। বুড়ির মুখের দিকে তাকিয়ে নমিতার বুক মুচড়ে ওঠে।
–তুই শ্রীনাইল ধামে গিয়ে সিদ্ধপুরুষ কেশা বাবার নামে মানত কর।
নমিতার কথা বুড়ির দুকান ভরে বাজতে থাকে। সন্ধ্যা উতরে গেছে, ঘরে আলো দেয়া হয়নি। সলীম কলীম খেলা শেষে ঘরে ফিরেছে। গফুর এখনো ফিরেনি। তবু উঠতে পারে না বুড়ি, চুপচাপ বসেই থাকে। ওর মনে হয় নমিতার কথাগুলো ঘরের। চাল থেকে, বাঁশের বেড়া থেকে, পানের বাটা থেকে, ওর শাড়ির মধ্য থেকে, অনবরত উঠে আসছে। নমিতা চলে গেছে বেলা থাকতে। অথচ বুড়ি আচ্ছন্ন হয়ে বসে আছে।