- বইয়ের নামঃ সেলিনা হোসেনের গল্প
- লেখকের নামঃ সেলিনা হোসেন
- বিভাগসমূহঃগল্পের বই
দুর্নীতি – সেলিনা হোসেন
নিয়ামত রসুল যতদিন একা ছিলো ততদিন তার জীবনযাপনের ভাবনা ছিলো এক ধরনের। বিয়ের পরে দুমাস না যেতেই ওর মনে হচ্ছে ও অন্যরকম মানুষ হয়ে গেছে। বউয়ের সঙ্গে জড়িত জীবন যেহেতু ওর একার নয়, সেহেতু ও এখন এক ধরনের অস্বস্তির মধ্যে দিনযাপন করছে। বিয়ের দুমাসের মধ্যেই বউ বলেছে, তোমার চাকরিতে উপরিপাওনা আছে বলেই এখানে বিয়েতে রাজি হয়েছি, নইলে রাজি হতাম না। আমার জন্য কত প্রস্তাব ছিলো আমি রাজি হইনি।
নিয়ামত রসুল একথা শুনে অস্বস্তিতে আফরোজার দিকে তাকায়। ওর গলা শুকিয়ে যায় বুকের কাছে কি যেন একটা এসে আটকে থাকে। আফরোজা ভুরু কুঁচকে বলে, কি হলো? অমন করছো কেন? আমার কথা শুনে তুমি ভয় পেয়েছো মনে হচ্ছে। খুব কি খারাপ কিছু বলেছি?
-ইয়ে, মানে, তুমি আমাকে ঘুষ নিতে বলছো?
—ঘুষ কেন হবে? ওটা একটা উপরিপাওনা। তোমার যোগ্যতার সম্মানী। পরিশ্রমের জন্য বাড়তি আয়।
নিয়ামত রসুল গলা নিচু করে কঠিন স্বরে বলে, এটা দুর্নীতি।
—দুর্নীতি? হো-হো করে হাসে আফরোজা। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করেছে। বাবা পুলিশ অফিসার। আয়ের চেয়েও বাড়তি আয়ের প্রাচুর্য ছিলো বলে আয়েসেই জীবন কেটেছে। নিয়ামত রসুল বউয়ের হাসি শুনে বিব্রত মুখে চুপ করে থাকে। এটা যে হাসির বিষয় হতে পারে তাও কল্পনা করতেই পারে না। একবার ভাবে চেঁচিয়ে উঠে বলবে, এত হাসছো কেন? তোমার লজ্জা করে না হাসতে? কিন্তু বলা হয় না। ভয় করে, নিজের ভেতরে কুঁকরে যায়। পরক্ষণে নিজেকেই বলে, ভয়। কাকে? কিন্তু বুঝতে পারে না অদৃশ্য সুতোর টানটা কোথায়। এই না বুঝতে পারাই ওর এখন সবচেয়ে বড় সমস্যা। আসলে ও বুঝতে পারছে ভয়টা ধ্বস নামার। স্কুল শিক্ষক বাবা চাকরি শুরুতেই বলে দিয়েছিলো, বাবা সৎ উপার্জন খাওয়াবি। হারামের টাকা আমাদের জন্য না। ওটা আমরা ছুঁতে চাই না। এখন স্ত্রী অন্য জীবনের কথা বলছে। যে জীবনে ঢুকলে বাবা-মায়ের কাছ থেকে শেখা নিজেরও বিশ্বাস ধ্বসে পড়বে। নিয়ামত রসুল স্ত্রীর তীব্র দৃষ্টির সামনে বিষণ্ণ হতে থাকে। ওই দৃষ্টি ওর ভেতরে ঢুকলে ও চোর হয়ে যায়, বেরিয়ে এলে পুলিশ হয়। আফরোজা খেকিয়ে উঠে বলে, কি হলো তোমার?
—খেলছি।
–খেলছো? কার সঙ্গে?
–নিজের সঙ্গে।
—কিভাবে?
–বুঝবে না।
–বললে, আমিও খেলতাম।
—ওই খেলার সাধ্য তোমার নেই।
—খেলাটার নামটা বলো না?
—চোর-পুলিশ?
—চোর-পুলিশ? হো-হো করে হেসে ওঠে আফরোজা।
—চোর পুলিশ হতে পারে না, কিন্তু পুলিশ চোর হয়, তখন কিভাবে খেলবে? আফরোজা রেগে গিয়ে বলে, তুমি আমাকে অপমান করছো।
—আশ্চর্য, তুমি অপমান বোঝ?
এবার হো-হো করে হেসে ওঠে ও। মনে হয় সমস্ত বিষণ্ণতা কেটে গিয়ে ও নিজের মধ্যে ফিরে এসেছে। খেলায় ওর জিৎ হয়েছে। আফরোজা দুপদাপ পা ফেলে। অন্য ঘরে চলে যায়। নিয়ামত রসুল হাসতে হাসতে ভাবে, এভাবেই কি এ জীবনের রঙ দেখা শুরু হলো! ও দাঁতে ঠোঁট কাটে। হাসি এখন সারা ঘরে। দেয়াল থেকে, আসবাবপত্র থেকে হাব্বি ধ্বনি আসছে। নিয়ামত রসুল বাইরের পৃথিবী দেখবে বলে জানালার কাছে এসে দাঁড়ায়। জানালার শিকগুলো ভীষণ ঠাণ্ডা।
রদিন অফিস থেকে বাড়ি ফিরতে ভয় করে নিয়ামত রসুলের। অফিসে লাঞ্চ করার সময় থেকেই বিষয়টি ওকে আক্রান্ত করে। এক লোকমা ভাত গেলার সঙ্গে সঙ্গে মনে হয় সেটা বুকের ভেতরে আটকে গেছে এবং পরক্ষণে মনে হয় ওর শ্বশুর ওর ভেতরে ঢুকেছে। পুলিশ ভাবলেও তার মুখটা ভেসে ওঠে, চোর ভাবলেও তার মুখটা ভেসে ওঠে। ও ভাত খেতে পারে না। ওই এক লোকমা ভাত বুকের ভেতরে নিয়ে হাত গুটিয়ে বসে থাকে। প্লেটে পড়ে থাকে করলা ভাজি, কৈ মাছ আর লাউ ডালের চচ্চড়ি। কোনোটাই আফরোজার রান্না নয়, কাজের মেয়ের।
শেষ পর্যন্ত বাড়ি ফিরতেই হয়। আফরোজার মেকি হাসি ওকে আরো ম্রিয়মাণ করে দেয়। ও সহজ হতে পারে না। মনে হয় আফরোজা জণ্ডিসের রোগী, চোখের গভীর কোটরের ভেতর থেকে তাকিয়ে থাকে। ঘামতে থাকে নিয়ামত রসুল। ওর ঘাম দেখে রেগে যায় আফরোজা। চেঁচিয়ে বলে, কেমন সে বিদঘুঁটে গন্ধ তোমার ঘামে। কাছে এসে দাঁড়াতেও ঘেন্না হয়।
—ইয়ে, দাঁড়াও,গোসল করে আসি।
ও জুতোটা খুলে ঘরের একপ্রান্তে ছুঁয়ে ফেলে বাথরুমে ঢোকে। দরজায় পিঠে ঠেকিয়ে বড় করে শ্বাসটেনে বলে, এটা পালানোর একটা দারুণ জায়গা।
কিছুক্ষণ এভাবে কাটিয়ে ও সাওয়ারের নিচে এসে দাঁড়ায় মনে হয় দূর থেকে কেউ ওকে শান্ত হতে বলছে, বলছে স্থির হতে। কিন্তু হয় না। ভেত্রটা যেমন ছিলো তেমনই থাকে।
দরজায় শব্দ করে আফরোজা।
—আর কতক্ষণ? বের হও না?
শব্দ করে না নিয়ামত রসুল। ঘাপটি মেরে থাকে। বাথরুমের ছোটঘরে শুধু জল পড়ার শব্দ। বাইরে আফরোজার কণ্ঠস্বর।
–শুনছো? কি হলো? আর কতক্ষণ?
—আসছি।
নিয়ামত রসুল সাওয়ারের ট্যাপ বন্ধ করে। গা মোছে। লুঙি পরে এবং খানিকটা ভেজা শরীর নিয়ে বেরিয়ে আসে। ভাবে, শরীরটা জলে আর ঘামে মাখামাখি হলে আর কটু গন্ধ বের হবে না। বুকের ভেতরে স্বস্তি নিয়ে বের হতে গিয়ে থমকে দাঁড়ায়, কি অদ্ভুতভাবে বেঁচে থাকার পথ খুঁজছে ও। কেমন স্বাভাবিক নিয়মে পন্থা এসে যাচ্ছে চিন্তায় এর জন্য কোনো আগাম ভাবনা ভাবতে হচ্ছে না। নিজেকেই বললো, এমনটি হওয়ার কথা ছিলো না, লু হলো। আশ্চর্য, বুকের ওপর আঙুল বুলিয়ে দাগ টানলো। কিছু একটা খুঁজতে চাইলে নিজের ভেত্র। দোষটা কি ওর না দুলাভাইয়ের? দুলাভাইতো তার মামাতো বোনের জন্য ওকে পছন্দ করতেই পারে! আসলে দায়িত্বটাতো ওর নিজেরই ছিলো। ও নিজেই সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করেছে এখন আর কাউকে দোষারোপ করা যাবে না। আফরোজাকে দেখে আপত্তি করে নি ও। ভেবেছিলো বিয়ে হলে সব ঠিক হয়ে যাবে। স্টুপিড, নিজেকে গাল দিয়ে দরজা খোলে। আফরোজা নেই। হয়তো বেডরুমে। ও ভেজা তোয়ালে হাতে নিয়ে বারান্দায় আসে। দড়ির ওপর ভোয়ালেটা মেলে দিয়ে ভোয়ালের এক প্রান্তে মুখ গোঁজে। সুগন্ধি আসছে তোয়ালে থেকে? হয়তো ভোয়ালেটা আফরোজা ব্যবহার করেছিলো। শুনতে পায় অদৃশ্য কণ্ঠ: নিয়ামত রসুল জীবন সম্পর্কিত ভাবনায় বেশ হিসেবি তোক। কি করা উচিত এবং কি করা উচিত নয় এটা ও ভালোভাবে যাচাই করে দেখার বাসনা রাখে। ছোটবেলা থেকেই ও এমন স্বভাব পেয়েছে। কার কাছ থেকে? মা না বাবা? নিয়ামত রসুল তা ভাবতে পারে না। কখনো মনে হয় দু’জনের কাছ থেকেই, কখনো মনে হয় ও নিজের ভেতর থেকে এই প্রেরণা গড়ে তুলেছে। এটাকে স্বশিক্ষাও বলা যেতে পারে।