মনে হয় নীতাও একটা কিছু করছে। অন্তত গানে গানে মন্ত্র ছড়াচ্ছে। ওর গানের গলা এখন বোমা হয়ে অসংখ্য লোকের বুকের পুল দুম করে ফাটিয়ে দিচ্ছে। নীতা কাজ পেয়ে মহান হয়েছে। আর বুড়ি? পরক্ষণে চোখ পড়ে রইসের দিকে। সতেরো বছর বয়স ওর। দেহটা বেশ সুঠাম। ওর বেড়ে ওঠাতে কোন ফাঁক নেই। কোন ঘাটতিও নেই। কিন্তু ওর মুখ দিয়ে লালা পড়ছে। ও বাম হাত দিয়ে একটা মাছি তাড়াবার চেষ্টা করছে। বারান্দায় পা ঝুলিয়ে বসে পা দোলাচ্ছে। চারদিকে বোকার মতো তাকাচ্ছে, কখনো হাততালি দিয়ে হাসছে।
বুড়ি উঠোনে দাঁড়িয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। কি হবে এই ছেলে দিয়ে? ও ভাইয়ের মৃত্যুকে উপলব্ধি করতে পারেনি। দেশ জুড়ে যে এত বড় ঘটনা ঘটে যাচ্ছে তার সঙ্গে ওর কোন যোগ নেই। পৃথিবীর সব ঘটনা থেকে বিচ্ছিন্ন। বুড়ির ভীষণ কান্না পেলো। ও তো পারতো ভাইয়ের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে। ও তো পারতো জনযুদ্ধের অংশীদার হতে। মুক্তিবাহিনীর একজন হয়ে বেপরোয়া যোদ্ধা মানুষ হতে। বুড়ির চকিতে মনে হলো এ ছেলের বেঁচে থেকে কি লাভ? এ ছেলে না থাকলেই ভাল। প্রতি মুহূর্তে এতোবড় একটি ছেলের অসহায় পঙ্গুত্ব বুড়িকে যন্ত্রণার নরকে দগ্ধ করে। পর মুহূর্তে মন ছটফটিয়ে ওঠে। দৌড়ে আসে বারান্দায়। রইসের মাথা বুকে জড়িয়ে ধরে। চোখের পানিতে ভিজিয়ে দেয় মাথা, নাক, গাল। রইস বিরক্ত হয়। বুড়িকে হাত দিয়ে সরিয়ে দেয়। ঠেলে ফেলতে চায়। বুড়ি তবুও যখন ছাড়ে না তখন ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে নিচে নেমে যায়। যেন মায়ের এ ধরনের আচরণ সহ্য করতে রাজি নয়। ও কাচারীঘরের দিকে হাঁটতে থাকে। অকারণে হাঁসগুলো তাড়ায়। বাঘার পিঠে দুঘা বসিয়ে দেয়। বুড়ি ওর ওপর রাগ করতে পারে না। ওর ওপর রাগ করলে সেটা নিজের ওপর এসে পড়ে। কষ্ট হয়। কলীমের মৃত্যু কাটা হয়ে বিধে থাকে হৃৎপিণ্ডে। কয়েকজন দানব আকারের মানুষের ছায়া বুড়িকে গ্রাস করে। ক্ষণিকের জন্যে ওর নড়ে ওঠার ক্ষমতা রোধ হয়ে যায়।
কদিন পর কাদের আর হাফিজের বাবা রমজান আলীকে ধরে নিয়ে গেলো মিলিটারি। দুতিন দিন চাপা ছিল খবরটা। কিন্তু বেশিদিন রাখা গেলো না। কিভাবে যেন জানতে পারে ওরা। তাই মারমুখী হয়ে ছুটে এসেছে। ওরা মারপিট করলো বাড়ির লোকদের। বুড়ির ভাগ্য ভাল যে ওর ঘরে আসেনি। কলীমকে মেরে যাবার পর ওরা আর ঘরে ঢোকেনি। ও ঘরে বসে শুনেছে পুরুষদের আর্তচিৎকার, মেয়েদের কান্না, ছোটদের হৈচৈ। বুড়ি শুধু বসে বসে আল্লার কাছে তার নিজস্ব প্রার্থনা করেছে। মানুষ। দাও। মানুষ দাও। ওরা চলে যাবার পর সমস্ত বাড়িটা নিঝুম হয়ে গেলে বুড়ির চকিতে মনে হয়, কে এ কাজটা করলো? ও কি একবারও বুঝতে পারেনি যে বিশ্বাসঘাতকতা ও নিজের সঙ্গেই করলো? করলো নিজের পায়ের তলার মাটির সঙ্গে। এ মাটির রঙ যে চেনে না সে মাটিতে পা রাখার অধিকার তার নেই। বুড়ির ইচ্ছে করে সে বিশ্বাসঘাতকের টুটি চেপে ধরতে। মনসুরের কথা মনে হতেই রক্ত ছলকে ওঠে। সলীমের কথা ও-ই বলেছিল। দুদিন আগে জলপাই গাছের নিচে দাঁড়িয়ে মনসুর ওকে জিজ্ঞেস করেছিল, রমজান আলীর ছেলে দুটাকে আর দেখছি না যে?
–ওদের নানাবাড়ি গেছে।
–তাই নাকি?
–হ্যাঁ, ওদের নানার খুব অসুখ।
–ওদের মা গেলো না?
–ওদের মার তো শরীর খারাপ। ভরা মাস যে।
–অ।
মনসুর হেসেছিল?
–তোমার এতো খোঁজে দরকার কি বাপু?
–না, এমনি।
মনসুর আর দাঁড়ায়নি। হনহন করে মেঠো পথে নেমে গিয়েছিল। ওর কালো ছাতি অনেক দূরে মিলিয়ে যাবার পরও বুড়ির মনে হয়নি যে মনসুর কথাটা আদৌ বিশ্বাস করেনি। উল্টো আরো সাতকাহন গেয়ে লাগিয়েছিল। এখন বুড়ি নিজের উত্তেজনা চেপে রাখতে পারে না। মনসুর তুই একটা বেজন্মা। তোর মা-বাপের জন্মেরও ঠিক নাই। তুই যাদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিস ওরা তোর কে? তুই ভুলে গেলি তোর চৌদ্দ পুরুষের ভিটেমাটির কথা? তোর সঙ্গে একই জলহাওয়ায় বেড়ে ওঠা মানুষগুলোর কথা! এ মাটি এখনো তোকে ছুড়ে ফেলে দেয় না কেন মনসুর!
বুড়ি আরো শক্ত কথা বলতে চায়। কিন্তু যুৎসই কিছু মুখে আসে না। শুধু ক্রোধ বাড়ে–ঘৃণা বাড়ে। বুড়ির মুখে কথা আসে না। শুধু ক্রোধ বাড়ে আর ঘৃণা বাড়ে। শুধু ক্রোধ আর ঘৃণা। শেষে আর একবার মুখ খোলে, মনসুর তোর আর আমার ভাষা এক, মাটি এক এ লজ্জায় আমি বাঁচি না যে! ও সুপোরি বাগানের নিরিবিলি ছায়ায় আসে। কলীমের কবরের কাছে এসে দাঁড়ায়। জায়গাটা বড় শ্যামল শীতল। বুড়ির ভীষণ প্রিয়। এখানে এলে ও নিজের দুঃখের কথা ভুলতে পারে। তখন ওর সাহস বাড়ে। বুকের দিগন্ত প্রসারিত হয়ে যায়। মহাসমুদ্রের মত অনবরত গর্জনে উন্মাতাল হয়ে ওঠে বুড়ির হৃৎপিণ্ড।
১০. পরদিন রমজান আলী ফিরে এল
পরদিন রমজান আলী ফিরে এল। গায়ে জ্বর। সারা শরীরে ব্যথা। মারের চোটে কাহিল হয়ে পড়েছে বেচারা। বিছানা থেকে উঠতে পারে না। বুড়ি দেখতে গিয়েছিল। ওকে দেখে রমজান আলী কিছু বলেনি। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেছিল। বুড়ি অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে। রমজান আলীর বৌ গায়ে তেল মালিশ করে দেয়। ও উঠে যেতেই বুড়ি কাছে আসে।
–রমজান ভাই কষ্টটা মনে না গায়ে?
–গায়ে।
রমজান আলী স্থির কণ্ঠে বলে।
–ওরা একটা ভাল কাজে গেছে রমজান ভাই।
–সে আমি জানি।
–ওদের তুমি দোয়া করো। এতক্ষণে রমজান আলী সামান্য হাসে।
–রইসের মা কলীম গেছে তবু তুমি ভাঙনি।