ওদের কথা শুনে অভিভূত হয়ে যায় বুড়ি। আবেগে চোখ ছলছল করে।
–তোরা ঠিকই বলেছিস বাবা। তোরা এতো কথা ভাবলি কখন?
কাদের আর হাফিজ হাসে।
–তোমরা সবাই ভাব আমরা ছোট। স্কুল পেরিয়েছি কেবল।
–ওরে নারে না। তোরা আমার বুকের মানিক। তোরাই তো পারবি। বুড়ো হাবড়াদের দিয়ে কি কিছু হবে?
সে রাতে কাদের আর হাফিজ ঘুমোতে গেলে অনেকদিন পর বুড়ি বুক ভরে শ্বাস নেয়। এক ঘুমে রাত পার হয়ে যায়। বারবার ঘুম ভাঙে না।
মাঝে মাঝে বুড়ি বাঁশবনে গিয়ে দাঁড়ায়। পথের দিকে তাকিয়ে থাকে। যদি সলীম ফিরে আসে ঐ পথে। দূরের বিন্দুটা যদি কাছে আসতে আসতে সলীম হয়ে যায়। দিন গড়ায়। বুড়ির আকাঙ্ক্ষা আর সত্য হয় না। পুকুর ঘাটে গিয়ে বসে। দেখে নারকেল গাছের ছায়া আস্তে আস্তে কেমন ছোট হয়ে যায়। হাঁসের দল গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ায় পাড়ে। শ্যাওলা সবুজ জল নীতার কথা মনে করিয়ে দেয়। নীতা আর আসেনি। বেঁচে আছে কি না তাও জানে না। ওকে একবার কাছে পেলে হতো। নিঃশব্দ মুহূর্তগুলো আর সহ্য হয় না। নীতা এখনো হয়তো কণ্ঠে ভালোবাসার গান নিয়ে একখান থেকে আর একখানে ছুটে বেড়াচ্ছে। অখিল বাউল ওকে নতুন জীবন দিয়েছে। বুড়ির দিনগুলো বালিহাঁসের পাখার মত ধূসর। রাতের ভাষা আরো নিঃশব্দ। বুড়ির চেতনার আকাশ ছায়াপথ যেন।
মাসখানেক পর কাদের আর হাফিজ এসে বুড়ির দরজায় টোকা দেয়। তখনো ভোর হয়নি। আঁধার দ্রুত সরে যাচ্ছে। বুড়ির বুক ধড়ফড়িয়ে ওঠে। কি আবার হলো? চকিতে মনে হয় গুলির শব্দ, আগুন, রক্ত, মৃত্যু ইত্যকার বিবিধ ভাবনা। অনেকক্ষণ বুড়ি নড়তে পারে না। মনে হয় কলীমের মা ডাকের তীব্র চিৎকার। সঙ্গে সঙ্গে একরাশ গুলির শব্দ। বুড়ির কান ঝাকিয়ে দেয়। বাইরে ওরা অস্থির হয়ে ওঠে। দেরি করার সময় নেই। এদিক ওদিক হলে বাতাসও শত্রুতা করতে পারে। কাদের আর হাফিজের। কিছু হলো না তো? বুড়ি স্থির হয়ে থাকে। বাইরে ওদের অস্থির কণ্ঠ উচ্চ হয়।
–চাচি, ও চাচি?
সেই ডাকে বুড়ির রক্ত নাড়া দিয়ে ওঠে।
–কিরে এতো রাতে কি?
–আমরা যাচ্ছি।
–কোথায়?
–মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিতে। আমরা যুদ্ধ, করব। আপনাকে বলেছিলাম না? কাউকে কিছু বলিনি। শুধু আপনাকে বলে যাচ্ছি। আপনি বাবাকে বুঝিয়ে বলবেন।
বুড়ির মনে হয় অবিকল সলীমের কণ্ঠ। এমনি করে সলীম একদিন চলে গিয়েছে। বুড়ির ঠোঁট কাঁপে থর থর করে।
–আমাদের দোয়া করেন চাচী যেন বুক ফুলিয়ে আবার ফিরে আসতে পারি।
ওরা পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে। বুড়ি অভিভূত হয়ে যায়। ওরা যে সত্যি এতটা সাহসী হয়ে উঠতে পারবে কাছে বসে ভাবতেই পারেনি তা। ওদের গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। দেবদূতের আলোর মতো ওরা এখন উজ্জ্বল। জিজ্ঞাসা উঁকি দেয়, ফেরেশতা কি এমনি হয়? এমনি জ্যোতির্ময়? আরো মনে হয় ওদের শরীর থেকে কেমন একটা গন্ধ আসছে। অপার্থিব গন্ধ। সেই মোহিনী গন্ধ বুড়িকে পাগল করে দেয়। ছেলে দুটোর হাত উঠিয়ে নাকের কাছে নিয়ে শুকে দেখে। না কোন বিশেষ জায়গা থেকে নয়। চারদিক থেকে একটা অদ্ভুত গন্ধ ভেসে আসছে।
–কি চাচি? কাদের আর হাফিজ অবাক হয়।
–কিছু না। দোয়া করি–দোয়া করি। বুড়ির ঠোঁট কাঁপে। আর কিছু বলতে পারে না।
–যাই চাচি। বুকে বল রাখবেন। আপনার কিছু ভয় নাই। সময় সুযোগ মতো আমরা আসব আপনার কাছে। কোন দরকার হলে বাবাকে বলবেন। এ আঁধারের গায়ে মিলেমিশে ছেলে দুটো চলে যায়। বুড়ির মনে হলো ওর চারপাশে এখন আর কোন আঁধার নেই। দুহাতে আলো ছড়াতে ছড়াতে ওরা ফেরেশতার মতো চলে গেলো। ওরা এখন স্বর্গের সন্ধানে ব্যস্ত। বুড়িকে নতুন করে বেঁচে থাকার সাহস দিয়ে গেলো। মনে হয় এখন আর ওর তেমন ভয় করছে না। সমস্ত ভয় ধানের কুঁড়োর। মতো ঝেড়ে ফেলে দিল। ওরা চলে যাবার পর নিশ্চিন্তে ঘুম এলো ওর। বিছানায় শুয়ে শুনলো দূরে গুলির শব্দ। এখন নিবিড় ভাবনায় মগ্ন হয়ে বুড়ি প্রার্থনা করে, আল্লা আরো মানুষ দাও। সাহসী বেপরোয়া মানুষ দাও। বানে-ডোবা হলদী গাঁয়ের মতো মানুষের বানে ভাসিয়ে দাও আমাদের।
বুড়ি আবার নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ে। কাদের হাফিজের সঙ্গে কথা বলে তবু কিছুটা সময় কাটতো। এখন কথার জন্যে ব্যাকুল হয়ে ওঠে। অসহ্য নীরবতাকে চিরে দুটুকরো করে ফেলতে ইচ্ছে করে। মনে পড়ে রমিজার মাছ-কাটা বঁটির কথা। খুব ধারালো ছিল বঁটিটা। পোচ দিলেই কচ্ করে কেটে যেতো। কিন্তু নীরবতাকে কি কাটা যায়? নীরবতা কেনো মাছের মতো একটা জীবন্ত কিছু নয়? কুটুম পাখি আর ডাকে না।
অথবা ডাকলেও বুড়ির মাথায় তা তেমন করে ঢোকে না। হঠাৎ করে দুএকটা শালিক। কিচকিচ্ করে ওঠে রান্নাঘরের চালের ওপর। ওর মনে হয় অলৌকিক কণ্ঠস্বরের মতো। কে যেন অলিখিত ভাষায় ভীষণ কিছু পাঠ করে যাচ্ছে। বুড়ি তা বুঝতে পারছে না। অথচ ঐ শব্দটুকুর জন্যে যেন কতো কালের প্রতীক্ষা বুড়ির। দূরে যখন কোথাও বোমা ফাটে, যখন পুল ভেঙে যায় তখন বুড়ির নিশ্বাস দ্রুত হয়। ঐ শব্দগুলো মনে হয় নিজের অস্তিত্বের চাইতে বেশি, শ্বাস-প্রশ্বাসের চেয়েও মূল্যবান।
তিন-চারদিন পর দক্ষিণ দিকের ঘরের ছেলেটি এসে বুড়ির পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে।
–খালা দোয়া কর মুক্তিবাহিনীতে যাচ্ছি।
বুড়ি দোয়া করে। হাসিমুখে বিদায় দেয়। মনে মনে আশ্বস্ত হয়। এক দুই করে অনেক ছেলে চলে গেছে। আল্লা বুড়ির কথা শুনছে। আল্লা বুড়িকে মানুষ দিচ্ছে। স্রোতের মতো ওরা আসছে। চারপাশের ছেলেগুলোর ভেতর এতো তেজ ছিল তা একবারও টের পেলো না কেনো? তাহলে বুড়ির উপলব্ধিতে কোথাও কি কোন ফাঁক ছিল? দৃপ্ত ভঙ্গিতে চলে যাওয়া ছেলেটির গমন পথের দিকে তাকিয়ে থাকে। ও পিছু তাকায় না। কোনদিকে খেয়াল করে না। সামনে লক্ষ্য করে এগিয়ে যাচ্ছে। পুরো হলদী গাঁ এখন ঐ ছেলেগুলোর শক্তির ওপর ভর করে দাঁড়িয়ে আছে। ওদের কাছে। নিজেকে খুব তুচ্ছ মনে হয় বুড়ির। বুড়ি কোন কাজেই আসে না। ওদের মতো অমন করে ছুটে বেরিয়ে পড়তে পারে না। ওর শক্তি নেই, সে বয়সও নেই। অথচ বুড়ি কাজ চায়। হলদী গাঁ-র জন্যে কিছু করতে চায়? হলদী গা-যে বুড়ির প্রাণের চাইতেও প্রিয়।