রমিজার বাবা ঘুম থেকে উঠেই মেয়েকে তাগাদা দেয়।
তাড়াতাড়ি গোছগাছ কর। বেলা ওঠার আগেই রওনা দেব। দুপুর নাগাদ বড়বাজার পৌছতে পারলে সন্ধ্যার আগে বাড়ি পৌছে যাব। জানিস তো রাত্রিবেলা মধু মাঝি নৌকা বাইতে চায় না।
–কিন্তু বাবা আমি গেলে ….
–আবার কথা। শুনলাম তো কালরাতের ঘটনা। কানে তো আর তুলা দিয়ে রাখিনি। আজ রাতে যে এ ঘরে আসবে না কে জানে। আমাদের এলাকা এখনো মুক্তিবাহিনীর দখলে। মিলিটারি ঢুকতেই পারেনি। তাছাড়া অত ভেতরে ওরা যেতেও সাহস পাচ্ছে না। যা তাড়াতাড়ি কর।
রমিজা বাবার সামনে থেকে সরে পড়ে। মনে মনে বলে বাবা চিরকাল এমনি একটু শুকনো কথা বলে। মনে মনে যত ভালইবাসুক, একটুও আদর করে কথা বলতে জানে না। বুড়ি ঘর থেকে সব কথাই শোনে। খোয়াড়ে দুটো হাঁসের ডিম পেয়েছে। তাই ভেজে পান্তা সাজিয়ে দেয় বেয়াইকে। মাটির সানকির ওপর বুড়ির হাত নিথর হয়ে যায়।
রমিজা বুড়ির সামনে এসে দাঁড়ায়, আম্মা?
–দেরি করার কাজ নেই রমিজা। তাড়াতাড়ি রওনা হওয়া ভাল। বেলা হলে ছেলেটার কষ্ট হবে।
–আম্মা?
–আর কথা বাড়াস না। তোর বাবা ঠিকই বলেছে। আজ রাতে যে এ ঘরে হামলা হবে না কে জানে?
–আপনি একলা কি করে থাকবেন? আপনিও আমার সঙ্গে চলেন?
–আমার জন্য ভাবনা নেই। আল্লা আছে। তারপর বুড়ি ফিসফিসিয়ে বলে, বাড়ি খালি করে সবার যাওয়া ঠিক না। সলীম যদি ফিরে আসে?
বুড়ির কথায় রমিজার কান্না পায়। বাবার ভয়ে শব্দ করে কাঁদতে পারে না। চোখ মুছতে মুছতে চলে যায়। ফুলির ঘটনায় ওর মনও দুর্বল হয়ে গেছে। জোরাজুরি করে থাকবার সাহসটুকু নিজের মনেও খুব একটা নেই।
খালের ধার পর্যন্ত ওদের সঙ্গে সঙ্গে আসে বুড়ি। নাতিটা বুকের মধ্যে হাত পা ছুড়ছে। ওকে নিবিড় করে চেপে ধরতেই বুক ভেঙে আসে। তবুও নিজেকে দুর্বল হতে দেয় না। রইস বুড়ির পিছু পিছু হটছে। তখনো সূর্য ওঠেনি। নরম আলো চারদিকে। রমিজা বারবার আঁচলে চোখ মোছে। ওর বুকে ভীষণ কষ্ট। অনেকদিন সলীমের খবর নেই। বুড়িকে একলা ফেলে নিজে স্বার্থপরের মত চলে যাচ্ছে বলে মনটা খচখচ্ করে। তবুও রমিজাকে যেতে হচ্ছে। ও স্যাণ্ডেল খুলে হাতে নিয়ে কাদা পাড়িয়ে নৌকায়। ওঠে। ছেলেটা কোলে। ও বারবার বুড়ির দিকে হাত বাড়ায়। ওর কাছে আসতে চায়। বুড়ি পুতুলের মত দাঁড়িয়ে থাকে। নড়তেও পারে না। নৌকো ছেড়ে দেয়। স্বচ্ছ পানিতে তরতর করে নৌকো এগোয়। রমিজার বাবা কি বলে যেন বিদায় নিয়েছে। সেকথা মনে থাকে না। কেবল মাথা নাড়ে। বুড়ি দেখে খালের বয়ে যাওয়া। জোয়ারের সময় এখন। পানি আসছে। দেখে বিক্ষিপ্ত কচুরিপানা বেগুনী ফুল বুকে নিয়ে ভাসে। খালের ওপারে মাঠ। কেবল মাঠ, মাঠের পর মাঠ। খালের বাঁকে নৌকো হারিয়ে যায়। আর দেখা যায় না। বুড়ির মন খা-খা করে। মনে হয় যে মনের ভেতর কেবল মাঠের পর মাঠ। জনমানব নেই। ঐ কচুরিপানার মত বুকের মধ্যে রইসকে নিয়ে বুড়ি ভাসছে। কোথায় যাবে জানে না। এই ভাসাটাই সত্য কেবল। গায়ে গা লাগিয়ে বাতাস বয়ে যায়। কালো ভোমরা একটা বারবার বুড়ির মুখের কাছে উড়ে আসে। রইস মা-র হাত ধরে টানাটানি করে। বাড়ির পথ দেখিয়ে দেয়। যাবার জন্যে ইশারা করে। ও কেমন অস্থির হয়ে উঠেছে। বাড়ি ছেড়ে ও কোথাও যেতে চায় না। কোথাও গেলে ফেরার জন্যে ব্যাকুল হয়ে ওঠে। বুড়ি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। ভীষণ কষ্টে বুক ফেটে যেতে চায়। কত কষ্টের ধন ও। বুড়ি ভাবে, কষ্ট করে পেয়েছে বলেই বুঝি কষ্টটা বুড়ির নাড়িতে গেঁথে গেছে। ওকে নিয়ে সুখ নেই। সূর্য ফুটিফুটি করছে। বাঁশ বনের মাথার ওপর দিয়ে লাল হয়েছে আকাশটা। রইসের হাত ধরে ফিরে আসে। ফুলিদের ঘরের সামনে লোক জড়ো হয়েছে। ফুলির মা গুনগুনিয়ে কাঁদে। ফুলির বাপ মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। সকলের মুখ শুকনো। কি করবে কেউ তা ভেবে উঠতে পারে না। বুড়ি ওদের কাছে এসে দাঁড়ায়। রমজান আলী বলে, বউকে পাঠিয়ে দিলে বুঝি।
–হ্যাঁ।
–খুব ভাল করে
–আমার কি হবে গো রইসের মা?
ফুলির বাবা হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। সেই সঙ্গে অনেকে চোখ মোছে। বুড়ির রাগ হয়। কারো বুকে কোন সাহস নেই। আছে কেবল চোখের জল। কি জঘন্য! সকলে জড়ো হয়ে কাঁদতে বসেছে। ফুলির বাপের সঙ্গে কথা না বলে নিজের ঘরে ফিরে আসে। একবার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে যে সবাই এমন শুকনো মুখ নিয়ে বসে থাকলে সারা গাঁ উজাড় হয়ে যাবে। কিন্তু কাকে বলবে? কেউ কি আছে গায়ে? সব মেরুদণ্ড ভাঙা। কুঁজো হওয়া অথর্ব বুড়ো। বুড়ি একদলা থুতু ফেলে। কারো কাছে দুদণ্ড বসে মন খুলে কথা বলারও উপায় নেই। ভয়ে চিমসে থাকে।
গত সন্ধ্যায় রমিজা ঘরে ঘরে গিয়ে বিদায় নিয়েছে। সবাইকে বলেছে বুড়ির দেখাশোনা করতে। আগে যারা খোজ নেবার দরকার মনে করত না এখন তারা একবার করে আসে। রমজান আলীর ছেলে কাদের আর হাফিজ বাইরের ঘরে ঘুমোয়। ছেলে দুটিকে সারাক্ষণ আগলে রাখে রমজান আলী। পালিয়ে পালিয়ে বেড়ায় ওরা। কেবল কৈশোর পার হয়েছে ওদের। অনেক কিছুই বোঝে না। বুড়িকে ওরা ভীষণ ভালবাসে। ফুলিকে ধরে নিয়ে যাবার পর একদিন রাতের অন্ধকারে বুড়ির সামনে গর্জে উঠেছিল দুভাই, এভাবে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াতে আমাদের বড় ঘেন্না হয় চাচি। ইচ্ছে করে একদিন পালিয়ে গিয়ে মুক্তি বাহিনীতে যোগ দেই।
হাফিজ বলে, বাবা সব সময় ভয় পায় কখন মিলিটারি ধরে নিয়ে আমাদের মেরে ফেলে। আমার মনে হয় মরতেই যদি হয় তাহলে ওদের সঙ্গে লড়েই মরি। তবু তো বাবার মনে গর্ব থাকবে যে তার ছেলে যুদ্ধ করে মরেছে। আপনি কি বলেন চাচি?