বুড়ি দেখে কলীমের দেহ থেকে রক্তের স্রোত নেমেছে। গুচ্ছ গুচ্ছ শিমুল ফুলের মত লাল। ঐ শিমুল থেকে বীজ হবে। বীজ হয়ে ফাটবে। বাতাসে উড়ে বেড়াবে সাদা ধবধবে উজ্জ্বল তুলো। বুড়ির মনে হয় সমগ্র হলদী গাঁটা গুচ্ছ গুচ্ছ শিমুল হয়ে গেছে। ঐ শিমুলের সাঁকো পেরিয়েই হলদী গাঁ একমুঠো উজ্জ্বল তুলো হয়ে যাবে। আচমকা। বুড়ির মনে হয় সলীমরা এ কথাই তো বলত। হলদী, গায়ের লোকগুলোর চোখে মুখে এ স্বপ্নই তো ভাসতো। হ্যাঁ, স্পষ্ট মনে পড়ছে, যে শব্দটা ওরা সারাদিন বলাবলি করত, তা ছিল স্বাধীনতা। শিমুলের মত লাল রক্ত পেরিয়ে সে স্বাধীনতা তুলোর মত ধবধবে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
বুড়ি লক্ষ্য করে রইস কখন যেন কলীমের পাশে গিয়ে বসেছে। খুব আস্তে আস্তে কলীমের গায়ে মাথায় মুখে হাত বুলাচ্ছে। ও কিছু বুঝতে পারছে না। নিজের হাতে রক্তের দলা নেড়েচেড়ে দেখে। গন্ধ শোকে। তারপর একদৌড়ে বুড়ির কাছে ছুটে আসে। অবাক বিস্ময়ে দুর্বোধ্য শব্দে ও চিল্কারে বুড়িকে টানাটানি করে। চোখের সামনে সব কিছু কেমন আবছা অস্পষ্ট হয়ে যায়। রইসকে জড়িয়ে ধরে বুড়ি ডুকরে কেঁদে ওঠে। কলীমের তাজা রক্তের গন্ধ বুড়ির চেতনায়।
এক সময় কান্না থেমে যায়। রইসকে ধরে প্রবল ঝাঁকুনী দেয়। তুই কেন চুপ করে থাকিস রইস? তুই কোন কিছু করতে পারিস না? তুই ফেটে পড় রইস। আমিও তোর সঙ্গে থাকব। আমরা দুজনে মিলে হলদী গাঁয়ের জন্যে একটা কিছু করব। তোর কানটা যদি বোমা হয়ে ফেটে যায়। জিভটা যদি বুলেটের মত ছোটে? ও রইস তুই আমার গলা চেপে ধর। তুই আমাকে মেরে ফেল। বুড়ি গলা ফাটিয়ে কাঁদে। চিৎকারে বুকের ভেতরের সাত পরত দেয়াল ভেঙে গুড়িয়ে যায়। আশপাশের ঘরের লোকজন এসে ভিড় করে কলীমের পাশে। রমিজা কতদূরে পালিয়েছে কে জানে? এখনও ফিরেনি। রমজান আলী এবং আরো কারা যেন কলীমকে বারান্দার ওপর উঠিয়ে নিয়ে আসে। কবর দেয়ার কথা বলাবলি করে। বাকি সবাই বিমূঢ়। বুড়ি কোন কিছু শুনতে পায় না। কোন কিছু দেখতে পায় না। দেখে কলীমের রক্ত হলদী গাঁ শুষে নিচ্ছে। মাটি ভেদ করে সে রক্ত নিচে চলে যাচ্ছে। উপরের অংশ জমাট বেঁধে কালো হয়ে আছে। ও বিড়বিড় করে, হলদী গাঁ রক্ত খাচ্ছে। রমজান আলী জিজ্ঞেস করে, কি বলেন রইসের মা?
এ বুড়ি শূন্য দৃষ্টিতে তাকায়।
–কলীমকে সুপারি বাগানে কবর দিন রমজান ভাই।
–সে আমি সব ঠিক করব। আপনি কিছু ভাববেন না।
রমজান আলী চোখ মুছতে মুছতে নেমে যায়। ছেলে-মেয়েরা ভিড় করে রক্ত দেখছে। কেউ কেউ হাত দিয়ে নাড়ছে। বুড়ির শূন্য দৃষ্টি আবার সে রক্তের ওপর গিয়ে আছড়ে পড়ে। মনে হয় কলীমের রক্ত হলদী গাঁয়ের মাটিতে নতুন পলিমাটি। আপন শক্তিতে উর্বরা হবার জন্যে হলদী গা সে রক্ত ধারণ করছে। ওর মাথা পাক দিয়ে ওঠে। বাঁশের খুঁটিতে হেলান দেয়। তখুনি শুনতে পায় বুক ফাটা চিৎকার করতে করতে রমিজা ঘরে ফিরছে।
দিন গড়ায়। বদলে যায় বুড়ির আপন ভুবন। যেন একটু ভুতুড়ে বাড়ির মধ্যে ওরা কটা প্রাণী চুপচাপ বসে থাকে। রাত্রি হলে কারো মধ্যে কোনো প্রাণ থাকে না। মাঝে মাঝে রমিজার ছেলে যখন জোরে কেঁদে ওঠে তখন ওরা বুঝি নিজেদের অস্তিত্ব টের পায়। তাও কি কাদবার জো আছে। ছেলে কাদলে রমিজা যেখানে থাকুক ছুটে আসবে। সঙ্গে সঙ্গে ছেলেকে থামিয়ে ফেলবে। বুড়ির মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে যে ছেলেটা চেঁচাক। জোরে জোরে কেঁদে এই গা-টা মাতিয়ে তুলুক। ঐ দৈত্যগুলো ভাবুক যে এ গাঁয়ের লোকগুলো সব মরে যায়নি। বুড়ির ভাবনা রমিজা ধরতে পারে না। ধরার ক্ষমতাও নেই। তাই বুড়ির সঙ্গে ও রাগ করে। ওর ধারণা বুড়ি ছেলেটাকে ইচ্ছে করে কাদায়। কাদিয়ে মজা পায়। তাই বুড়ির কাছে দিয়ে রমিজার স্বস্তি নেই। বুড়ি আপত্তি করে কখনো কখনো।
–ওকে একটু কাঁদতে দে না রমিজা? ওর দম আটকে কি তুই ওকে মেরে ফেলবি?
–কি যে বলেন আম্মা? কাদলেই তো দৈত্যগুলো ছুটতে ছুটতে আসবে। তারপর সবাইকে গুলি করবে।
–করলেই হলো আর কি?
কথাটা বলেই থমকে যায় বুড়ি। থমকে যায় রমিজাও। পুকুরের পশ্চিম পাড়ে কলীমকে কবর দেয়া হয়েছে। সুপোরির ছায়ায় নিরিবিলি শুয়ে আছে। সবুজ ঘাসে ভরে গেছে সে কবর। রমিজা পাতা বাহারের গাছ লাগিয়েছিল সেটাও বেশ বড় হয়েছে। হলদী গাঁ কলীমের জন্যে কি সুন্দর সবুজ শান্তির ঘর বানিয়ে দিয়েছে। বুড়ির বুক কেমন করে। বড় করে শ্বাস নেয়। ঐ কবরের কাছে গিয়ে বসলে হলদী গাঁ-র জন্যে মমতা বাড়ে। কলীম যুদ্ধ করেনি, কিন্তু হলদী গাঁ-র জন্যে প্রাণ দিয়েছে। বুড়ি এখন রইসকে নিয়ে বাগানে সুপপারি খুঁজতে যায় না। কলীমের কাছে যায়। কিছু দোয়াদরুদ পড়ে। চোখের পানি আঁচলে মুছতে মুছতে ফিরে আসে। উঠোনের দিকে চোখ পড়ে। মাটি খুঁড়লে হয়তো উঠোনে রক্তের দাগও বেরিয়ে যেতে পারে। তবুও বুড়ি আস্তে আস্তে বলে, গুলি করা কি অত সহজ?
–সবই সহজ। রমিজা কথা খুঁজে পায়। এখন সবই সহজ। ছোট ভাইকে মেরে ফেললো। শামুর মার কথা একবার চিন্তা করেন আম্মা। কি যে দিনকাল হল।
রমিজা চাল বাছায় মনোযোগী হয়। শামুর মার কথা ও সহ্য করতে পারে না। বুড়ির বুকটাও মোচড় দিয়ে ওঠে। বেচারী।
কলীমকে যেদিন মারলো ঐদিনই পাটক্ষেতের একবুক পানির মধ্যে লুকিয়েছিল ওরা সবাই। একটু দূরের রাস্তা দিয়ে একদল সৈন্য যাচ্ছিল।
কোলের ছেলেটা কেঁদে উঠতেই শামুর মা ওকে পানির তলে চেপে ধরে। কোন কিছু ভাববার সময় ছিল না তখন। মিলিটারি চলে গেলে ওরা সবাই উঠে এল। শামুর মার বুকে তখন ছেলে মরে ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। বাড়ি ফেরার অর্ধেক পথ এলে শামুর মা টের পায়। ভয়ে এত তটস্থ ছিল যে বুঝতেই পারেনি। কোল বদল করার সময়ই টের পায় যে ছেলেটা নড়ছে না। ভয়ে শামুর মা চিৎকার করেও কাঁদতে পারেনি। অসাড় হয়ে গিয়েছিল অনুভূতি! বোবার মত ফ্যালফ্যাল করে চেয়েছিল। এখন ওর মাথার ঠিক নেই। দিনরাত বলে, ছেলেটাকে আমি নিজের হাতে মেরে ফেললাম। আল্লারে আমার কি হল? বুড়ি শামুর মার সামনে বেশিক্ষণ থাকতে পারে না। সইতে পারে না টলটলে জলভরা বোবা চাউনি। রমিজার মত বুড়িও বিড়বিড় করে, কি যে দিনকাল হল। এমনি আরো কত ঘটনা আছে। রোজই কিছু না কিছু ঘটে। কোনটা ছেড়ে কোনটা মনে রাখবে। রমিজার চাল বাছা শেষ হয়েছে। ভাত চড়াবে। ও চালের টুকরি নিয়ে পুকুর ঘাটের দিকে হাঁটতে থাকে। যেতে যেতে বলে, দেখবেন আম্মা ও যেন কাঁদে না। কান্না শুনলে আমার বুক ধড়ফড় করে।