সে ওষুধে কেউ ভালো হয়ে গেলে নিজের উপর আস্থা দ্বিগুণ হয়। নতুন উদ্যমে আবার অন্য পরীক্ষায় যায়। হরেণ আর মালতী নানা ধরনের রোগী নিয়ে আসে। বুড়োরা যেমন আসে, তেমনি শিশুরাও। আগে আশেপাশের লোকজনকে ডেকে ওষুধ দিতো। এখন আর ডাকতে হয় না। একজন দুজন রোজই আসে। কোনোদিন বেশিও আসে। লোকে উপকার পাচ্ছে। সোহরাব আলির এখন আর হার্বেরিয়াম গড়ে তোলার স্বপ্ন নেই। ভাবে, দূর ভবিষ্যতের চিন্তা এখন আর করা যাবে না। এখন ভাবতে হবে বর্তমানের কথা ভাবতে হবে মানুষের সুস্থ থাকার কথা। এখানকার মানুষের জন্য চিকিৎসাব্যবস্থা তেমন নেই। বেশিরভাগ লোকই নানা অসুখে ভোগে। ভুগতে ভুগতে কখনো আপন নিয়মে ভালো হয়, নয়তো আর। ভালো হয়ে ওঠা হয় না। মৃত্যুর দিন গোনে। সোহরাব আলির মনে হয় যত্ন দিয়ে চিকিৎসা দেয়াই হবে তার জন্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এভাবেই মানুষের কাছে যাওয়া যায়। ওদের সুখ-দুঃখের অংশী হওয়া যায়। এ মন্দ নতুন যাত্রা নয়। নিজের ওপরই নিজের আস্থা জন্মায়। মাঝে মাঝে আফসানা খাতুনও বলে, খুব একটা উপকারের কাজে হাত দিয়েছে। মানুষ তোমাকে দোয়া করবে। আগে তো মেয়েরা ওষুধের জন্য আসত না। এখন দেখি ওরাও আসতে শুরু করেছে গো।
তুমি খুশি হয়েছে নীরু?
হ্যাঁ, ভীষণ খুশি হয়েছি। এমন করে শান্তিতে বাস করতে পারবো আমি ভাবতে পারিনি।
সোহরাব আলি গভীর ভালোবাসায় জীবনসঙ্গিনীর দিকে তাকায়। বলে, রোগীদের সঙ্গে কথা বললে বুকের ভার হালকা হয়। ওরা অনায়াসে নিজের সুখ-দুখের কথা গড়গড়িয়ে বলে যায়। এদের কোনো সংকোচ নেই। ওরা। আমাকে খুব আপন ভাবে গো।
আল্লাহ, তোমার ভালো করুক। আমরা যেন সুখে শান্তিতে জীবন কাটাতে পারি। আমাদের ছেলেরা যেন মানুষের মতো মানুষ হয়।
আফসানা খাতুন আঁচল দিয়ে চোখের জল মোছে।
সোহরাব আলি নিজেও আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে। বলে, নীরু লোকগুলো কি ভীষণ সরল! বহরমপুরের লোকেরা এমন ছিল না। ওদের মাঝখানে একটা আড়াল ছিল। ওরা কাছে এলেও দুরত্ব রাখতো। কিন্তু এখানকার লোকদের ঐ সবের বালাই নেই। যাকে বিশ্বাস করে তাকে মনপ্রাণ ঢেলে দেয়। নিজের ঘরে খাবার না থাকলেও একটা লাউ কিংবা এক জগ দুধ জোর করে দিয়ে যায়। নিতে না চাইলে মুখ কালো করে। সে তো আমি দেখতে পাচ্ছি। ওদের দেয়া জিনিস দিয়ে তরকারি রধিলে সেদিন দীপু ভীষণ খুশি হয়। ও ঠিকই বুঝতে পারে যে কোনটা সরাসরি গাছ থেকে ছিঁড়ে আনা তরকারি, আর কোনটা বাজার থেকে কেনা।
দুজনে আবার দুজনের কাজে চলে যায়। এভাবে দুজনের নতুন জগৎ গড়ে উঠতে থাকে। নতুন দেশ, নতুন মানুষ এক জীবনের সঞ্চয় পূর্ণ করে দেয়। সোহরাব আলি প্রায়ই ভাবে, এটুকু করে যেতে পারলেই শান্তি। এই জীবনে তার আর কিছু চাওয়ার নেই। এ দেশের মানুষ সোহরাব আলির জন্য ভিন্ন অভিজ্ঞতা। কেউ ভালো হয়ে গেলে যখন এসে বলে, ডাক্তার সাব, শরীরে আর রোগবালাই নাই। একদম ভালো হয়ে গেছি। ডাক্তার সাব আল্লাহ আপনাকে অনেক দিন বাঁচিয়ে রাখুক। আল্লাহই তো আপনাকে আমাদের কাছে পাঠিয়েছে।
তখন কেমন বিস্ময় লাগে। মানুষের এমন অনুভব তাকে হতবাক করে দেয়। সোহরাব চট করে কিছু বলতে পারে না। ঘন ঘন মাথা নাড়ায় শুধু। মাথা নাড়াতে নাড়াতে বলে, তুমি আমাকে কোথায় তুলেছো তুমি জানো না কুদ্স। আমার মনে হয় আমার মাথা আকাশ ছুঁয়েছে। ওহ, কুদ্স আমার বুকের ভেতর আনন্দের সমুদ্র ঢুকে গেছে। ওখানে শুধুই জোয়ার, জোয়ার।
ডাক্তার সাব, আপনার কি শরীর খারাপ লাগছে?
না তো, আমি তো ভালোই আছি।
আল্লাহ যেন আপনাকে ভালো রাখেন। ডাক্তার সাব, আপনি ভালো থাকলে আমরাও ভালো থাকব। যাই। আমাদের জন্য দোয়া করবেন।
যাই।
চলে যায় কুদ্দুস। সামনে এসে বসে ঘোমটা মাথায় একজন নারী। মৃদু কণ্ঠে বলে, ডাক্তার সাব!
সোহরাব চমকে তাকায়। এদের কাছে সে কত অনায়াসে একজন ডাক্তার হয়ে গেছে। এদের কত নির্ভরতা তার ওপর। রোগীদের নাম ঠিকানা অসুখের বিবরণ লেখার খাতার পাতা উল্টিয়ে জিজ্ঞেস করে, আপনার নাম কি মা?
হালিমা খাতুন।
বয়স কত?
হালিমা খাতুন প্রথমে বলে, জানি না। তারপর একটু চিন্তা করে বলে, লেখেন পঞ্চাশ।
পঞ্চাশ বোধ হয় না। আরও কম হবে।
তারপর মুখ উজ্জ্বল করে বলে, দুনিয়াজুড়ে যে একটা যুদ্ধ লাগছিল তারও অনেক বছর আগে আমার জন্ম।
সোহরাব আলি বুঝতে পারে যে, হালিমা খাতুন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কথা বলছে। তারপর নিজে অনুমান করে একচল্লিশ বছর লেখে।
কি হয়েছে মা আপনার?
খুসখুসে কাশি আর জ্বর।
জিভ দেখান।
শুরু হয় নানা কথা। শেষ পর্যন্ত তা ছেলেমেয়ে, উপার্জন, এমনকি জায়গা জমিন পর্যন্ত গড়ায়। সোহরাব আলির বিশ্বাস প্রতিটি মানুষের স্বাস্থ্য তার জীবনযাপনের পরিবেশ, মানসিক ক্ষতি ইত্যাদি অনেক কিছুর উপর নির্ভর করে। অসুখ কোনো একক বিষয় নয়, অসুখ বহুর সমন্বয়। তাই যতটা সম্ভব একজন রোগীর নানা কিছু জানার চেষ্টা করে।
এক ফাঁকে হালিমা খাতুন জিজ্ঞেস করে, আমি ভালো হবে তো ডাক্তার সাব?
ভালো-মন্দ রাখার মালিক আল্লাহ। আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা করি।
ঠিকই বলেছেন ডাক্তার সাব।
হালিমা খাতুন মাথার ঘোমটা টেনে সোজা হয়ে বসে। সোহরাব আলি মনোযোগ দিয়ে অসুখের ধরন বোঝার চেষ্টা করে। ওষুধ নির্ধারণ করে। বুঝতে পারে এদের জন্য কিছু করার চেষ্টায় তার মন ব্যাকুল হয়ে থাকে। এটাকে নিজের সাধনাও মনে করে সে। নিজেকে বলে, সাধনা না করলে। সিদ্ধি আসে না। সিদ্ধি লাভই তো সাধনার শেষ কথা। কারো জ্বর কমে যাওয়া, আমাশয় ভালো হওয়া, শশাথের উপশম হওয়া এখন সোহরাব আলির জন্য দারুণ আনন্দের। গভীর প্রশান্তি তার রাতের ঘুম নিবিড় করে। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কখনো বিড়বিড় করে, নিমপাতার পানিতে ভালো করে পাঁচড়াগুলো ধুয়ে নেবে। তারপর এই কাঁচা হলুদ বাটা লাগিয়ে দেবে। দেখবে চার-পাঁচ দিনের মধ্যেই তোমার ছেলে ভালো হয়ে গেছে আক্কাস। যাও, এখন বাড়ি যাও। না, আর আসতে হবে না।