তুমিও ছোটমানুষ হয়ে যাচ্ছো। উচ্ছ্বাসটা একদম দশ বছরের মেয়ের মতো।
তাই নাকি। এই আমি চললাম।
আফসানা খাতুন দ্রুতপায়ে হেঁটে আসে। সোহরাব আলি এক মুহূর্ত দেখে। তারপর পেছন থেকে ডাকে।
দাঁড়াও নীরু, আমাকে ফেলে যেও না। এখন একলা হাঁটতে আমার ভীষণ ভয় করে।
কেন? আফসানা খাতুন অবাক হয়ে তাকায়।
মনে হয় জনার্দন ভোজালিটা নিয়ে তাড়া করে আসছে। আমি দৌড়তে পারছি না। মুখ থুবড়ে পড়ে যাচ্ছি। আমার দম আটকে আসছে। নিশ্বাস নেয়ার মতো একটু বাতাসও কোথাও নেই।
আফসানা খাতুন ভয় এবং উদ্বেগে স্বামীর দুহাত চেপে ধরে বলে, ওগো এসব আর ভেবো না। বলো, আর কখনো ভাববে না। আমরা এমন ভাবলে, আমাদের ছোট দীপুকে আমরা মানুষ করতে পারব না। তুমি কি। চাও যে আমরা এসব কথা ভেবে আমাদের সংসার ছারখার করি?
আফসানা খাতুনের কণ্ঠে একরাশ ব্যাকুলতা ঝড়ে পড়ে।
ভাবতে তো চাই না। একলা হলেই এমন হয়। তুমি আর কখনো আমাকে একা রেখে আর কোথাও হেঁটে যেও না।
চলল, ঘরে যাই। আমার মনে হচ্ছে তোমার পিপাসা পেয়েছে। আমি তোমাকে লেবুর শরবত বানিয়ে দেব।
দুজনে হাঁটতে থাকে। আফসানা খাতুন মুঠিভরে তুলসি পাতা ছিঁড়ে গন্ধ শোঁকে। সোহরাব আলির খুব ইচ্ছে করে আফসানা খাতুনের হাতটা মুঠিতে নিয়ে হাঁটতে। তখুনি ঝোপের আড়াল থেকে দীপু বেরিয়ে আসে।
তোমরা এখনো বাগানে বেড়াচ্ছো? বুঝতে পারছি বাগানে বেড়াতে তোমাদের ভালো লাগছে। লাগবেই তো, আমারও ভালো লাগছে। বাগানটার মধ্যে ঘুরলে না বুননা মানুষের মতো লাগে নিজেকে। আজ তোমাকে ভীষণ খুশি-খুশি দেখাচ্ছে বাবা।
তাই না কি রে?
হ্যাঁ বাবা তোমরা রোজ রোজ বাগানে বেড়াও না কেন? তাহলে তোমাদের একটুও মন খারাপ থাকবে নাদখবে, তোমরা যে বাগানটা ছেড়ে এসেছো তার কথা মনে করে আমাদের কান্না পাবে না। ভাববে এই বাগানটাও অনেক সুন্দর।
তোকে কে বলেছে যে আমাদের কান্না পায়? আমাদের মন খারাপ থাকে?
আমি বুঝি। মা সবসময় বাগানে আসে না বলেই তো মার মন খারাপ। থাকে। আর আমাকে বকে। আমাকে বকলে বুঝতে পারি যে মায়ের মন ভালো নেই। যে ছেলেটি মায়ের কাছে সোনার ছেলে তাকে বকলে তো মা নিজেই কষ্ট পায়।
তাই তো। তুই তো অনেক বুঝিস রে বাবা।
সোহরাব আলি হো হো করে হাসে।
আফসানা খাতুন ছেলেকে জড়িয়ে ধরে বলে, আর তোকে বকবো না দীপু। দেখবি এখন থেকে আর আমি একটুও মন খারাপ করবো না।
ঠিক বলছো? মনে থাকবে তো?
একদম ঠিক। চল, ঘরে চল। আর ঘুরতে হবে না। রোদে তোর মুখ লাল হয়ে গেছে।
তোমরা যাও আমি আর একটু থাকি মা।
আহ্ দীপু সারাদিন কেবল খেলা!
কিন্তু দীপু ততক্ষণে হাওয়া। সোহরাব আলি আফসানা খাতুনের হাত নিজের মুঠিতে নেয়। আফসানা খাতুন প্রথমে অবাক হয়, তারপর হেসে ফেলে।
বাগান পেয়ে দীপুটার ভারি ফুর্তি হয়েছে।
আমারও। আফসানা খাতুন বলে। বাগান পেয়ে আমারও নতুন জীবন ফিরে এসেছে। নইলে যেই অবস্থায় এসেছি তাতে কি ঘাড় তুলে দাঁড়াবার সাধ্য ছিল।
এজন্যই আমরা পালিয়ে আসার দুঃখ অনেকটা ভুলতে পারছি নীরু। আমিও তোমার মতো বলতে চাই যে নতুন জীবন পেয়েছি। ঠিক।
আফসানা খাতুন প্রবলভাবে ঘাড় নেড়ে বলে।
আমার মনে হয় বাগানে আমি সারা দিন কাটাই। তুমিও আমার পাশে ঐ ছাতিমতলায় বসে থাকো।
দুজনে একসঙ্গে সিড়িতে ওঠে। বারান্দা পেরিয়ে ঘর। আফসানা খাতুন রান্নাঘরে যায়। সোহরাব আলি নিজের ঘরে ঢোকে।
বয়সের ধাক্কা সামলিয়ে এবং মন খারাপ কাটিয়ে ওঠার পর সোহরাব আলি আস্তে আস্তে নিজের শক্তিতে ফিরে আসে। বুঝতে পারে ফিরে আসাটা নিয়ম। যে ফিরতে পারে না সময় তাকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যায়। সোহরাব আলি তো তেমন মানুষ নয় যে সময়ের কাছে হেরে যাবে। নিজের হাতের তালুর দিকে তাকিয়ে এলোমেলো রেখার মাঝে সময়ের হিসাব করে সোহরাব আলি। নিজেকে বলে, এখনো অনেক সময় সামনে। হারব কেন? হারতে তো শিখিনি। যা শিখিনি সেটাই বা এই বয়সে এসে বড় হয়ে উঠবে কেন? ফেলে আসা জগণ্টা ফিরে পাবার জন্য তৎপর হয় সে। চুপচাপ বসে থেকে অর্থহীন সময় কাটানো তার স্বভাবে নেই। বাগানে এলেই মনে হয় এই তার মাটি, এখানেই শেকড় চারানোর জায়গা। শেকড় গজালে অধিকার জন্মায়। মানুষের জীবনে অধিকার আদায় একটি বড় জিনিস। যে রাজনীতির জন্য আজ তার এই রিফিউজি হয়ে যাওয়া, সেই বোধকে নতুন শক্তি দিয়ে উড়িয়ে দিতে হবে। প্রতিজ্ঞায় উদ্দীপিত হয়ে ওঠে সোহরাব আলি। পুরো পরিবারকে এমন বোধেই সাহসী করে তুলতে হবে। নিজেকে সে বিচ্ছিন্ন ভাববে কেন? ইচ্ছে করলে কিছু একটা গড়তে পারে। অধিকার নিয়ে না এগুলে কেউ সেটা হাতে তুলে দেয় না। সোহরাব আলির মনে হয় এখন আবার নতুন করে দিন গোনার সময়। নতুন করে শুরু করতে হবে এবং তা এখনই। সময় নষ্ট করার সময় নেই।
শুরু হয় নতুন উদ্যমে কাজ। বাগানের নানা ধরনের গুল্ম-লতাপাতা ইত্যাদি খুঁটিয়ে দেখে কয়েকদিন। দেখে বুঝতে পারে এই বাগান যার ছিল সে হয়তো নিজে আয়ুর্বেদী চিকিৎসক ছিল। এখানকার বেশিরভাগ উদ্ভিদই ঔষধি গুল্ম। সোহরাব আলি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। তাকে চিকিৎসা সেবা দিতে হবে। নিজে তো ওষুধ বানাতে জানে। আফসানা খাতুন সহযোগিতা করবে। হরেণ-মালতীর সাহায্য নেবে। অল্প দিনেই নিজের জায়গা তৈরি করতে পারবে, এই আত্মবিশ্বাস সোহরাব আলিকে সবল করে তোলে। বুঝতে পারে হার্ট জাতীয় গুল্মের দিকেই তার আকর্ষণ প্রবল হয়েছে। সোহরাব আলি তা দিয়ে ওষুধ বানায়।