আফসানা খাতুন চমকে সোহরাব আলির দিকে তাকায়। তারপর বলে, ওগো চলো ঐ ছাতিম গাছটার নিচে বসি। কেমন থোকা থোকা সাদা ফুল হয়েছে।
হ্যাঁ নীরু, ভালো একটা গন্ধও আসছে। আমি এতক্ষণ খেয়ালই করিনি। তোমার অসুখের পর থেকে আমার মাথাটাও কেমন হয়ে থাকে।
দুজনে ছাতিমতলায় আসে। নুয়ে থাকা মাথা টেনে ধরে ফুলের গন্ধ শোকে। বারবার শুকে বুক ভরে শ্বাস টানে। তারপর ছেড়ে দেয়। দেখতে পায় ডালের মাথায় বসে আছে টুনটুনি—টুনটুন শব্দ করছে। ওহ, কি যে সুন্দর দেখতে!
আফসানা খাতুন উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে, দেখো, দেখো।
শব্দ পেয়ে ফুড়ৎ করে উড়ে যায় টুনটুনি। ওটা দৃষ্টির আড়ালে না যাওয়া পর্যন্ত দুজনে তাকিয়ে থাকে।
তারপর হেঁটে যায় সামনে।
আফসানা খাতুন বলে, বহরমপুরে আমাদের বাগানটা আরো ছিমছাম ছিল। একদম ছবির মতো গোছানো। তুমি বাগানটার যত্ন করতে খুব। আমরাও হাত লাগাতাম। নইলে বাগান ছিমছাম রাখা কি সহজ কাজ।
সোহরাব আলি একটু আবেগতাড়িত হয়ে ওঠে, সে কথা ভুলে যাও। নীরু। এখন ছিমছাম কোনো কিছু আমার আর ভালো লাগে না। এই এলোমেলো ভাবটাই ভালো। আমার মনে হয় যে ভদ্রলোকের বাড়ি ছিল, বাগান সাজানোয় তার মন ছিল কেবল গাছের বিস্তারে। সেই বেড়ে ওঠায় তিনি বোধহয় আনন্দ পেতেন নীরু। এখন থেকে আমিও ভাবছি সাজিয়ে গুছিয়ে বিন্যস্ত করলে কৃত্রিমতা বাড়ে। তার চেয়ে এই বুনো ভাব থাক। দেখছো না কেমন নতুন লাগছে। মনে হচ্ছে দিক ভুলে যেন কোনো দেশে এসেছি। সেটা অন্যের নয়, সেটা আমারই দেশ। চলো গাছেদের ঘরগেরস্থি দেখি।
সেই ভালো। এমনই থাক। এমন এলোমেলো। যেমন আমাদের দিনগুলো এলোমেলো হয়ে গেল এমন। আমরা আর কোনোকিছু সাজানোর কথা ভাবব না।
ঠিকই বলেছো। সোহরাব আলি আফসানা খাতুনের হাত ধরে।
ছাতিমতলায় বসবে মনে করলেও বসা হয় না। নতুন গাছ আর অচেনা স্পর্শ অনেকদিন দুজনের জীবনে বন্ধ ছিল। পালিয়ে আসার ষড়যন্ত্রে জীবনের দক্ষিণ দিকের দুয়োরটা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এই বাগান আচমকা সে দুয়োর হাট করে খুলে দেয়। দুজনের হাঁটতে খুব ভালো লাগে। কাঁটায় আফসানা খাতুনের শাড়ি ছিঁড়ে যায়, সেদিকে খেয়াল নেই। ঝোপঝাপ পেরিয়ে হাঁটাটাই এ মুহূর্তে আনন্দের। সোহরাব আলি আকন্দের ফুল ভেঙে হাতে নিয়ে মৃদু হাসে।
তোমার খোঁপায় দেই নীরু।
কি যে বলো? বয়স হয়েছে না। চুল সাদা হয়ে গেছে। তাতে কি, বয়স তো আমারও হয়েছে। দুজনে একইভাবে এগুচ্ছি। এমন তো নয় যে একজনে বয়সটা চেপে ধরে থেমে গেছি। কাজেই আমার কাছে তোমার আবেদন একই রকম। শুধু খোঁপায় ফুল দেয়া কেন, আমি এখন ইচ্ছে করলে যা খুশি তা করতে পারি।
যা খুশি তা? আফসানা খাতুন চোখ কপালে তোলে।
একদম যা খুশি তা। তুমি কি তৃণশয্যা বোঝ—
উঃ একদম বক্তৃতা শুরু করলে।
তুমি তো বাধ্য করলে বক্তৃতা দিতে। আমারও খারাপ লাগছে যে খোঁপায় একটা ফুল পরাবার জন্য এত কথা বলতে হচ্ছে।
আফসানা খাতুন হেসে ফেলে।
সেটা তো তোমার দোষ। বয়সকালে তো জোর করে গুঁজে দিতে।
বয়সটা থাকলে কি আর এমন হেরে যেতাম।
ঠিক আছে দাও। দিয়ে বাহাদুরি নাও। শান্ত হও।
সোহরাব আলি আফসানা খাতুনের খোঁপায় ফুল গুঁজে দেয়। মাথায় আর ঘোমটা দেয়া হয় না ওর। লম্বা আঁচল পিঠে ঝোলে। দুজনে করমচা গাছটার কাছে এসে দাঁড়ালে আড়াল থেকে দীপু বেরিয়ে আসে। ফড়িং ধরায় ব্যস্ত ও।
কি করছিস রে? লুকিয়ে লুকিয়ে কি করছিস?
ফড়িং ধরছি মা। এ বাগানে না অনেক ফড়িং।
দেখিস হাতে পায়ে কাঁটা ফুটাস না যেন। ফড়িং ধরে আবার ছেড়ে দিচ্ছিস তো?
হ্যাঁ, মা দিচ্ছি। বাবা আমাকে কত্ত ছোটবেলায় শিখিয়েছিল ফড়িং ধরে পাখনা ছিড়তে হয় না।
লক্ষ্মী সোনা আমার।
ও মা তুমি খোঁপায় ফুল গুঁজেছো। ইস তোমাকে কি সুন্দর দেখাচ্ছে।
দেখছো ছেলের কাণ্ড—
আফসানা খাতুন ফুল খুলতে যায়।
না, না খুলো না। তুমি রোজ খোঁপায় ফুল দিও মা। দীপু দুহাতে মায়ের হাত চেপে ধরে। বলে, বাবা দেখো মাকে পরীর মতো লাগছে। একদম ফুলপরী।
পাগল ছেলে, এখন কি আর পরী থাকতে পারি। বুড়ো হয়েছি না।
বুড়ো হলে কি হয়? ফুল দিতে নেই বুঝি? হারে দিতে নেই। ফুল তো তোদের মতো ছোটদের জন্যে।
মিথ্যে বলছো মা। ফুল কখনো ছোটদের জন্য না। ফুল বুড়োদের জন্যও।
দীপু আঙুল তুলে মাকে শাসায়।
তুই ঠিক বলছিস দীপু। ফুল সবার জন্য। তুই তোর মাকে রোজ ফুল তুলে দিস।
তাই দেবো বাবা। মাকে ফুলের মুকুট বানিয়ে দেবো। মাকে তখন রানীর মতো লাগবে।
দীপু আর দাঁড়ায় না। আরেকটা ফড়িঙের পেছনে ছুটে যায়।
আমার পেছনে লেগেছো কেন বলো তো? তোমার জ্বালায় পারি না, ছেলেও পেছনে লাগল।
সেই বয়সকালের মতো তোমার মাথায় ফুল দেখতে আবার আমার সাধ হচ্ছে নীরু।
সোহরাব আলির গভীর কণ্ঠে আফসানা খাতুন আর কথা বলতে পারে। বুকের ভেতরে নিজের আবেগও তোলপাড় করে ওঠে। ভালোবাসার দিনগুলোর স্মরণে বুক মুচড়ে ওঠে। যে সময়গুলো হারিয়ে যায় তা আর বাস্তবে ফেরে না কিন্তু সাধ হয়ে জ্বালায়। বুক ঝাঝিয়ে দেয়। বয়সকে নতুন করে পেতে বলে। এই যে দুজনে অনেক দিন পর একসঙ্গে হাঁটছে, আসলে কিছু না। তবু কেন মনে হচ্ছে অনেক কিছু—অনেক কিছু।
হঠাৎ করে আফসানা খাতুন আকস্মিক উচ্ছ্বাসে বলে, দেখো, দেখো কি সুন্দর ফুল? কত ছোট একটা নাকফুলের মতো। অথচ রঙটা কি চমৎকার। যে উচ্ছ্বাসে কথা বলছিল সে উচ্ছাস দপ করে নিভে যায়। এক মুহূর্ত সোহরাব আলির দিকে থমকে তাকিয়ে বই ও মা হাসছো যে?