সোহরাব আলির চোখে পানি আসে।
কি পাগলামি। এখনই মরার কথা ভাবছিস কেন?
দীপেনের মুখও ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছিল। দুজনেরই মনে হয়েছিল মৃত্যুটা বড় বেশি সত্য। দুজনেই বুঝি সে দরজায় পৌঁছে গেছে। দীপেন কোনো কথা না বলে সোহরাব আলির সামনে থেকে পালিয়ে বেঁচেছিল।
কিন্তু ঘটনার টানাপােড়েনে জীবন নিয়ে পালিয়ে আসার সময় কিছুই আনতে পারেনি ও। নিজের জীবন, স্ত্রী এবং তিন ছেলে ছিল তার সম্বল। কয়েকটা শিট গুছিয়ে বেঁধে ওর হাতে নিতে গিয়ে হু হু করে কেঁদে ফেলেছিল দীপেন। সোহরাব আলির গলায় ঘড়ঘড় শব্দ ছাড়া আর কিছুই ছিল না। দীপেনকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিল শুধু। স্পর্শ দিয়ে শেষ। কোনো কথা হয়নি। রাতের অন্ধকারে সীমান্ত পাড়ি দিতে গিয়ে বোঁচকা-বুঁচকির সঙ্গে সেই শিটগুলোও হারিয়ে যায়। দিশেহারা মানুষের দল, নতুন টানা সীমানা লাইনে কাঁটাতার, ঘুটঘুটে অন্ধকার, ফিসফাস কথা, সবকিছু বিমূঢ়, হতচকিত করে রেখেছিল ওকে। এখন এই মুহূর্তে অনুভব করছে, তার বুকের পাঁজরে একটা বিরাট ফুটো হয়েছে। সেটা আর বুঝবার নয়। আমনুরা স্টেশনে ট্রেনের জানালা দিয়ে ঢুকিয়েছিল দীপুকে। ভিতর থেকে টেনে নামিয়েছিল মারুফ। অনেকগুলো বস্তা ছিল সে কামরার ভিতর। কি ছিল ওরা জানতো না। ঐ বস্তার ওপর বসে রাত কাটিয়েছিল সোহরাব
আলি মারুফ আর জাফরকে নিয়ে। মেঝেতে চাদর বিছিয়ে বসতে দিয়েছিল। অফিসানা খাতুনকে। চারদিকে ধুলো, দুর্গন্ধ, ঠেলে বমি আসে। নিশ্বাস বন্ধ করে বসে থাকা এক রকম। ভাবলে এখনো গা শিউরে ওঠে। এই দুঃসহ যন্ত্রণা কি নিদারুণ স্মৃতি হয়ে রইল। গতকাল দীপু প্রশ্ন করেছিল, আমরা। পালিয়ে এলাম কেন বাবা?
জানি না।
সোহরাব আলি মাথা নাড়ে। ছেলের কাছে কি মিথ্যে বললো? আসলেই কেন এই পলায়ন তা কি জানে ও? না কি জেনেও বুঝতে চাইছে না মন। মানে না বলে? দীপু কিছুক্ষণ বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে আপন। মনেই বলে, যাই বড় ভাইকে জিজ্ঞেস করি গে। তুমি আমাকে অনেক কথাই বলতে চাও না বাবা।
দীপু চলে গেলে সোহরাব আলি নিজেকে বলে, এ তো পালিয়ে এসে জীবন বাঁচানো নয় সোহরাব, তোমার অস্তিত্বের বিলুপ্তি। আর কি হবে, এখন কোনো রকমে দিন গোন।
মাস দুই গড়িয়ে গেল। বাগানটা অযত্নে পড়ে থাকে। কোনো উৎসাহ নেই। আফসানা খাতুন বেশ কিছুদিন অসুস্থ ছিল। প্রবল জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকে। ফিরে যেতে চায় পুরনো বাড়িতে। স্মৃতি ছাড়া আর সামনের সবকিছু ধূসর। জ্বরের ঘোরে আফসানা খাতুন অনবরত বলে গেল ফেলে আসা দিনের কথা। অস্পষ্ট নয়, ভীষণ স্পষ্ট করে বলা। তখন তার চারপাশে গোল হয়ে বসে থাকা পরিবারের আর সবার চোখ ভিজে ওঠে। মাথায় জলপট্টি লাগাতে লাগাতে কখনো হাত থেমে যায় সোহরাব আলির। মনে হয় এই এতটা বছরের বয়সের দুঃখ সব এক জায়গায় এসে জমা হয়েছে। এই পাহাড় পেরুবে কি ভাবে?
সোহরাব আলি যেদিন বাগানটা ঘুরে দেখার জন্য নামল, দেখে শুনে চমকে উঠল একদম। এমন কতকগুলো গুল আছে যেগুলো সে আগে কোনোদিন দেখেনি। এই বাগান তার দৃষ্টিকে গভীর ও ব্যাপক করে দিল। ঘরে ফিরে আফসানা খাতুনকে ডেকে আনল।
দেখো নীরু, এই গুল্মগুলো আমি আগে কখনো দেখিনি।
সত্যি? তুমি হার্বেরিয়াম শিট তৈরি করো।
আবার? আবার নতুন করে সামনে যদি আবার একটি নতুন দেশ হয়? আবার যদি আমার সবকিছু ধ্বংস হয়ে যায়?
আবার নতুন দেশ? কি যে বল না।
হতেও তো পারে। কে জানে সামনে কি আছে।
আফসানা খাতুন বিড়বিড় করে বলে, আবার যদি পালাতে হয়, তাহলে কোথায় পালাব আমরা? আমাদের তো পালানোর জায়গা নেই।
নেই বলো না নীরু। নতুন করে কী হবে আমরা জানি না। আমার মন বলছে আমাদের দেখার আরও কিছু বাকি রয়ে গেছে।
অতদিন আমরা বাঁচব না। নতুন করে কিছু হলে আমাদের ছেলেরা দেখবে।
হয়তো তাই হবে। কে জানে।
সোহরাব আলির কণ্ঠ খাদে নেমে যায়। দৃষ্টিতে উদাসীন দিনের ছায়া। সে দৃষ্টি দূরের মাঠ পেরিয়ে হলুদ দালানে গিয়ে পড়ে। পারিপার্শ্বিক থেকে সোহরাব আলি যেন বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। আফসানা খাতুন নিজেও ব্ৰিত বোধ করে। যে উৎসাহে কথাটা বলেছে সে উৎসাহ দুজনের কারো বয়সে নেই। না, শুধু বয়স নয়, সেই সময়ও নেই। যে সময়টা ছিল পরিপূর্ণ, নিটোল, সে সময়ের অর্ধেকটা সীমান্তের কাঁটাতারে ছিঁড়ে আছে। ইচ্ছে করলেই জোড়া লাগানো যায় না। হঠাৎ করে সোহরাব আলি আফসানা খাতুনের মুখোমুখি হয়। স্ত্রীর ক্লান্ত, বিষন্ন চোখে চোখ রাখলে বুক কেঁপে ওঠে। তবু জোর করে বলে, তুমি না বলেছিলে নীরু চোখে ভালো দেখছো না। চশমা লাগবে?
হ্যাঁ। মাঝে মাঝে ঝাপসা দেখি। চোখে পানি আসে। সুঁই-সুতোর কাজ করলে চোখে ব্যথা হয়।
তাহলে তুমি কেমন করে বোর্ডের ওপর গুল্ম গাঁথবে? তোমার কষ্ট হবে।
তা আমি পারবো। চশমা নিলে অসুবিধা হবে না। আর যে কাজে আনন্দ পাই সে কাজে আবার কষ্ট কি! তুমি শুরু করো। আমি ঠিকই পারবো।
কিন্তু আমি পারবো না নীরু। নতুন করে শুরু করার সাধ্য আর আমার নেই।
সোহরাব আলির অসহায় কণ্ঠে আফসানা খাতুনের কষ্ট হয়। মানুষটা এমন ছিল না। নিজের নেশা নিয়ে পিছিয়ে পড়া মানুষ সে নয়। একটা বিশাল ধাক্কায় সে ছিটকে পড়ে গেছে। আর উঠে দাঁড়াতে পারছে না। মুহূর্তে চোখের সামনে ভেসে ওঠে অন্ধকার রাতে সীমান্ত অতিক্রম। শক্ত মুঠিতে পরস্পরের হাত ধরে রাখা। পাছে কেউ আলাদা হয়ে যায় কিংবা পিছিয়ে থাকে, অথবা হারিয়ে যায় চিরদিনের মতো। কতটা পথ এভাবে হেঁটেছিল মনে পড়ে না। যে পথ দেখিয়ে নিয়ে এসেছিল তার মুখেও কথা ছিল না, ছিল সংকেত। একজন মানুষকে জীবনে বাঁচিয়ে দেয়ার জন্য ছোট্ট আলোর সংকেত। এখনো দুঃস্বপ্নের মতো মনে হয় সমস্ত ব্যাপারটা। ভাবলে শরীর কাঁটা দিয়ে ওঠে। অথচ এভাবে না এলে কচুকাটা হয়ে যেত। বেঁচে থাকা সম্ভব ছিল না। কি নিদারুণ হয়ে উঠেছিল শেষের তিন চারটে দিন। শুধু দীপেন আগলে রেখেছিল। হিংস্র মানুষের সামনে দীপেনেরও জীবনের ঝুঁকি ছিল। কিন্তু সে ঝুঁকির তোয়াক্কা করেনি। কখনো রুখে দাঁড়িয়েছে, কখনো ওদের বুঝিয়েছে। শেষ পর্যন্ত সবকিছু গুছিয়ে দিতে পেরেছে। নইলে কি যে হতো! সোহরাব আলি বিড়বিড়িয়ে বলে, আমি আর কিছু পারবো না নীরু। আমার পারার দিন শেষ। কেমন করে শুরু করতে হয় একদিন জেনেছিলাম, তেমন করে শেষ হয়ে যায় তাও দেখেছি। আর যে কটা দিন বেঁচে আছি, এভাবেই চলে যাক নীরু।