পেছন ফিরে তাকায় সে। সেলে আসা দিনগুলোতে একদিন ঐ নেশা দ্বীপ হয়ে গেল। সোহরাব আলি অন্যসব যোগাযোগ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলল। যখন যেখানে নতুন গুল্মের সন্ধান পেয়েছে নাওয়া-খাওয়া তুলে তার পেছনে লেগে থেকেছে। গুল্মটিকে শেকড়সহ উপড়ে এনে মাটি ধুয়ে কাগজের মধ্যে রেখে কাঠের ভাঁজে চাপ দিয়ে শুকিয়ে নিয়েছে। তারপর বোর্ড পেপারের ওপর সুন্দর করে সুঁই সুতো দিয়ে গেঁথে দিয়েছে আফসানা খাতুন। স্বামীর এই কাজটি সে সবসময় হাসিমুখে করেছে। অনেক সময় সংসারের সব কাজ ফেলে রেখেও করেছে, একটুও বিরক্ত হয়নি। বরং তার কাছেও এটি এক চমৎকার আনন্দের কাজ ছিল। মনে। হতো যে কাজে সেটাই প্রার্থনা। তাই সেই কাজটিতে প্রার্থনার মতো মনোযোগ দিতে হয়। এমন বিষয় কেউ তাকে শেখায়নি। এটি তার নিজের ভেতর থেকে উঠে আসা শিক্ষা। নিজে নিজে শেখাটা অনেক মূল্যবান। সুঁইয়ের একেকটি ফোঁড় এই মূল্যবান কাজটিকে ওকে ঘোরের ভেতর ঢুকিয়ে দেয়। তখন সে স্বামীর সঙ্গে সম্পর্কের সুতোটিও নতুন করে বুঝতে পারে। যেন নতুন একটি আবিষ্কার। এমন উপলব্ধির কথা সোহরাব আলিকে বললে সোহরাব আলি হো হো করে হাসে। হাসতে হাসতে আফসানা খাতুনের কপালের সামনে শুরু হওয়া সিঁথিতে চুমু দেয়।
এভাবেই জীবন—এভাবেই জীবনের ডালপালা গজায়—বসন্তে নতুন পাতা আসে—শীতে ঝরে যায়। সোহরাব আলি ছেলেদের বলে, তোদর মায়ের একটা ভালো গুণ এই যে সবসময় অন্যকে বোঝার চেষ্টা করে। এজন্যই আমার নেশা তার শরীরে অর্কিডের মতো প্রশ্রয় পায়। কোনো ধরনের হিসেবি চিন্তা সে নেশার গায়ে আঁচড় দেয় না। সোহরাব আলি মুখে নী স্বীকার করলেও মনে মনে বলে, আফসানা খাতুন গাছের মতো সহনশীল।
বোর্ডের ওপর গুল্ম গেঁথে সোহরাব আলির সামনে এনে রাখতো সে। দেখো তো পছন্দ হয় নাকি?
বাহ্ চমৎকার! তোমার মতো আর কে পারত! তুমি আমার কাজটাকে কাজের মতো কাজ করে দিয়েছে। আমি মরে গেলেও এগুলো থাকবে। আমার ছাত্রছাত্রীরা এগুলো দেখে শিখবে।
মৃদু হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠত আফসানা খাতুনের মুখ। চকচক করত দৃষ্টি—আর সেই মুহূর্তে দৃষ্টি সমুদ্রের মতো বিশাল হয়ে যেত। সোহরাব আলি বুঝে পেত যে জীবনটা শান্তিতে কেটে গেল। মানুষের জীবনে এর বেশি আর কিছু চাইবার নাই।
আফসানা খাতুনের তৈরি বোর্ডের এক কোণে লেবেল এঁটে সোহরাব আলি যত্ন করে লিখেছে গাছের বৈজ্ঞানিক নাম, গোত্রের নাম, স্থানীয় নাম, হার্ব, স্রাব অথবা বড় গাছ। আরো লিখলো, যে এলাকা থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে তার নাম, পরিবেশের বিবরণ, সংগ্রহের তারিখ ইত্যাদি। তাছাড়া নমুনা গাছের বিভিন্ন অংশের ছবি এঁকে সেই গাছের সার্বিক মাপ ও নানা ধরনের বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ করতো সেই বোর্ডে। এককথায় একটি সুন্দর হার্বেরিয়াম শিট। আলাদা একটি ঘরে সেগুলো যত্ন করে সাজিয়ে রেখেছিল।
নির্দিষ্ট কাজের মাঝে কখনো দীপেন এসে ঢুকতো, তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। শুধু বন্ধু নয়, সে সম্পর্কের অতিরিক্ত আরো কিছু ছিল তাদের মধ্যে। দীপেন হিসেবি এবং বুদ্ধিমান। সোহরাব আলি সরল, উদাসীন। তবু দুমেরুর দুজনের বন্ধুত্ব ছিল ঈর্ষণীয়। দীপেনের প্রতিটি পদক্ষেপ ছিল গোনা। কোনো ধরনের নেশার প্রশ্রয় ছিল না তার কাছে। সোহরাব আলিকে খোঁচা দিত। অবশ্য খোঁচাটা বিদ্বেষের নয়, খুঁচিয়ে আনন্দ পাওয়ার জন্য। বলতো, তোর এসব অকেজো নেশা আমি বুঝি না সোহরাব।
অকেজো কি রে? দেখিস এই করেই আমি একদিন একটা বিরাট হার্বেরিয়াম গড়ে তুলব।
তাতে হবেটা কি?
আমার আর হবে কি? মরার সময় সরকারকে দিয়ে যাব। জাতির উপকার হবে। এখানে গবেষণার কাজ হবে।
ও বাবা একেবারে অমর হওয়ার শখ!
দীপেন হো হো করে হাসে। সোহরাব আলি ব্ৰিত বোধ করে। লজ্জিত কষ্ঠে তাড়াতাড়ি বলে, অমরতার কথা আমি কখনো ভাবিনি দীপেন।
সোহরাব আলির মুখ দেখে দীপেনের মন হয় কথাটা বলা ঠিক হয়নি। প্রসঙ্গ নরম করে বলে, ভাবলে ক্ষতি নেই। কাজ তা ভালোই করছিস। তবে দেখিস এই করতে করতে নিজে আবার হাবেরিয়াম শিট হয়ে না যাস। কোনোদিন দেখব তো সারা শরীরে গুল্ম আঁটা।
সোহরাব আলি আবেগে দীপেনের হাত ধরেছিল, যত ঠাট্টাই করিস আশীর্বাদ কর তাই যেন হয়। আমার সাধনাই ঐ একটা। মাঝে মাঝে কি মনে হয় জানিস?
কথাটা বলে কিছুক্ষণ থমকে থাকে সোহরাব আলি। দীপেন ঘাড়ে হাত রেখে বলে, থেমে থাকলি যে? বল কি মনে হয়?
মনে হয় মরে যাওয়ার পরে আমার সারা শরীরে গুল্ম এঁটে আমাকে যদি কবরে পাঠানো হতো তাহলে আমি খুব খুশি হতাম।
যাহ, কি যে বলিস! দীপেন বন্ধুর হাত চেপে ধরে।
এ জন্যই তো চুপ করে ছিলাম। জানি এমন সাধ পূরণ হবে না।
এমন করে আর কখনো বলবি না।
দীপেন সাবধান করে দেয়।
না, বলব না। আমি জানি এটা বলার কথা না। তারপরও মানুষের ইচ্ছে অনিচ্ছের কিছু প্রশ্রয় তো কারো কারো কাছে থাকে। তুই আমার সেই প্রশ্রয়ের জায়গা।
সোহরাব আলির চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। বোঝাই যায় এই একটা জায়গায় ও অকৃত্রিম। যা বিশ্বাস করে তা মনে প্রাণেই করে। হিসেবি দীপেনের এই বিশ্বাস ভালো লাগে। বলে, পাগল।
তারপর প্রাণখুলে হাসে।
তোর আগে যদি আমি মরে যাই দীপেন, তাহলে আমার এই জিনিসগুলো কিন্তু তুই রক্ষা করিস। দেখবি আমার যত্নে গড়া এই জিনিসগুলো যেন নষ্ট হয়ে না যায়। তাহলে মরেও শান্তি পাব না।