বাবা তুমি কি ভাবছো? ঘুমোবে না?
যাই। হ্যাঁ, ঘুম পাচ্ছে। তবে মানুষের গলা শুনতে ভালো লাগছিল রে। মনে হচ্ছিল, আমি কান পেতে রই, আমার আপন হৃদয় গহন দ্বারে–
জাফর হেসে বলে, তুমি বেশ আছে। এতকিছুর পরও নিজের মতো করে ভাবতে পারছে।
সোহরাব আলি মৃদু হাসে।
তোমার কেমন লাগছে বাবা?
ভাবিনি এত আপন মনে হবে। আরো খারাপ কিছু ভেবে এসেছিলাম। মনে হয়েছিল ভীষণ কঠিন হবে সবকিছু গুছিয়ে নিতে। এখন মনে হচ্ছে তেমন কিছু নয়। সব একরকম ঠিকই আছে।
আমারও এমন মনে হচ্ছে। মাকে নিয়ে ভয় ছিল। মাও বোধহয় অনেকটা কাটিয়ে উঠেছে।
মারুফ সহজ হতে পারেনি।
হ্যাঁ। বাবা ভাইয়ার ব্যাপারটি তো একটু অন্যরকম। আঘাত পেয়েছে বেচারা, আমাদের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় আছে।
সোহরাব আলি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে দাড়তে বলে, সময়ই ওকে ঠিক করে দেবে।
জাফর হেসে ওঠে।
আমাদের শেষ ভরসাই সময় বাবা। সময়ের ওপর ভরসা করেই আমরা অনেক কিছু ছেড়ে দেই। সময়ের ওপর ছেড়ে দিয়ে নিজেরাও অনেক ভারমুক্ত হই।
সোহরাব আলি কথা বলে না। হরণ আর মালতী কাছে আসে।
যাই বাবু?
এখনই যাবে?
আর কি? সব গুছিয়ে রেখে গেলাম। কাল সকালে এসে আবার দিনের কাজ শুরু করবো।
আচ্ছা যাও। আসলে কি জানো হরেণ তোমাদের ছেড়ে দিতে মন চায়। তোমরা কাছে থাকলে জোর পাই।
আমরা তো কাছেই থাকি। ডাবলই চলে আসব।
ওরা এ বাড়ির দেয়ালের বাইরে একটা টিনের চালায় থাকে। গরু আছে ওদের। দুধ বিক্রি করে সংসার চালায়। এ বাড়িতে যারা ছিল ওদের সঙ্গে হরেণের হৃদ্যতা ছিল। সেই সূত্রে এ বাড়ির দেখাশোনা করেছে ওরা। হরেণ আর মালতী দেয়ালের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে যায়। গাছ-গাছালির মাঝ দিয়ে চিকন রাস্তা ওদের জানা। মুহূর্তে ওরা কোথায় আড়াল হলো জাফর। দেখতে পায় না। অন্ধকার যেন ওদের কাছে টেনে নিল। যেন অন্ধকারই ওদের জীবনের আলো। জাফরের বেশ লাগে ভাবতে অন্ধকারেরও সজীবতা আছে। অন্ধকার ছাড়া জীবনের অর্থ ফুস করে এক হয়ে যায়। এরকম অর্থ তো কখনো হাজার ফুল ফোটায় না।
সোহরাব আলি, আবার চেয়ারে বসে পড়ে। রাস্তায় রিকশার টুংটাং ধ্বনি নেই। মানুষের কণ্ঠস্বরও ভেসে আসে না। জাফর একমুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর বলে,
বাবা উঠবে না?
তুমি ঘুমোও। আমি একটু পরে আসছি।
সকালে বাড়িটা ঘুরে দেখে মন জুড়িয়ে গেল সবার। শেষ পর্যন্ত সোহরাব আলির পুরো পরিবারকে মানসিক আশ্রয় দিল বাগান নামের এলোমেলো, অগোছালো, ফাটাফুটো একখণ্ড ভূমি। সবাই ভাবলো এ যাত্রায় ওরা বেঁচে গেল, ওদের আর ভয় নেই। পাকিস্তানের সীমান্তে ঢোকার পরও ওদের ভয় কাটেনি। সন্ত্রস্ত, তটস্থ, আতঙ্ক যেন পিঠে আমূল ছুরি বসিয়ে দেয়ার জন্য একটা উদ্যত হাত তাড়া করে ফিরছে। দেশভাগের মাসখানেকের মধ্যেই পালিয়ে আসতে হলো ওদের। একে দেশভাগ, তার ওপর বহরমপুরের অমন ছিমছাম তরুলতাময় বাড়ি ছেড়ে আসার বেদনার তীব্রতা ছিল প্রচণ্ড। সোহরাব আলি এখনো ভেবে পায় না বাড়ি বদলের দায়-দায়িত্ব দীপেন কাঁধে না নিলে সে কি করতে? এ ধরনের সমস্যার কথা ভাবলে মাথা ঝিম মেরে যায়। চিন্তা করে কুলিয়ে উঠতে পারে না। রাতের আকাশের অগণিত তারার দিকে তাকিয়ে ভেসে দেখল, এমন বোধ নিয়ে ও বড় হয়েছে। অসহায় হয়ে যাওয়াকে নিজের ভাগ্য মনে করে। মাঝে মাঝে শিশুর চাইতেও অসহায় হয়ে যায়। নিজের এই অক্ষমতা এত বছরেও কাটিয়ে উঠতে পারল না। মনে মনে হেসে সোহরাব আলি। নিজেকেই বলে, আর কোনোদিনও পারবে না। এখন ছেলেদের ওপর ছেড়ে দিতে হবে অনেক কিছু।
যার সঙ্গে বাড়ি বদল হলো আয়ুর্বেদিতে গভীর জ্ঞান ছিল তার। সেজন্যই এত বড় বাগান এবং এত গু আর ছোটবড় গাছ। ভদ্রলোক দীপেনের আত্মীয়। দীপেন চেনে সোহরাব আলিকে। তাই এক মুহূর্ত দ্বিধা না করে নিজেই সিদ্ধান্ত নিয়ে কথা পাকা করে ফেলে। খুব অনায়াসে সবকিছু হয়ে যায়। সোহরাব আলির বহরমপুরের বাড়ি ছিল একদম অন্যরকম। লতা দিয়ে এমন করে জড়ানো ছিল যে কোনো দেয়াল দেখা যেতো না। কেবল দরজা-জানালাগুলো খোলা ছিল। অপরিচিত কেউ ঐ বাড়ির সামনে দিয়ে যেতে একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতো। কত যত্ন এবং পরিশ্রম করতে হয়েছিল ঐ লতাটার জন্য, ভাবলে বুক মুচড়ে ওঠে। কিন্তু সে ঠকেনি। দেশভাগের লাথিতে ছিটকে এসে এই বাগানে পড়েছে বলেই রক্ষে। নইলে এই ওলট-পালট জীবনযাপনে ক্ষুদ্র কীট হয়ে গিয়ে মানুষের মতো দিনযাপন হয়তো ভুলেই যেত। ভাবলেই শরীরের লোম দাঁড়িয়ে যায়। সোহরাব আলি কি জানে না এই সমাজে সত্যিকার মানুষের মতো বেঁচে থাকাই সবচেয়ে কঠিন। আবার নতুন উপাধি পেয়েছে রিফিউজি। হাঃ ওটা শরীরের চামড়ায় বাড়তি প্রলেপ। এ জীবনে আর মুছে ফেলতে পারবে না।
বহরমপুরের স্থানীয় হাইস্কুলের বোটানির মাস্টার ছিল সে। ছেলেদের বোঝাতে হার্ব মানে ছোট ছোট গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদ। যেমন গিমা, শিয়ালমুথা ইত্যাদি। স্রাব হলো অপেক্ষাকৃত বড় রকমের গাছ। যেমন গন্ধরাজ, হাস্নাহেনা, বেলী ইত্যাদি। ট্রি হলো বড় গাছ। যেমন–আম, জাম, সেগুন, কড়ই। কিন্তু নেশা ছিল বনৌষধির। টুকটাক ওষুধ বানিয়ে পাড়াপড়শির ছোটখাটো অসুখ সারাতো। শিক্ষকতার সঙ্গে নেশার যোগ ঘটিয়ে জীবনের চেহারা পাল্টে ফেলেছিল সোহরাব আলি। গায়ের লোকে ওকে বলতো মাস্টার-ডাক্তার। বড় আনন্দ পেত। আনন্দের মধ্যে ডুবে থেকে দুঃখ যে কি কখনো তা ভেবে দেখার সময়ই পায়নি। হায়রে, রাজনীতি! মানুষকে ঠেলে অন্য স্রোতে ফেলে দেয়। তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে তাকে ধোপর কাঠের মতো জীবনের তক্তায় আছড়ায়।