অল্পক্ষণে দাঁত বের করা হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠে বলে, দাদাবাবুদের খিদে পেয়েছে মা। মালতী ওদের খেতে দিয়েছে।
তুমি যাও। আমি আসছি।
হরেণ চলে গেলে আফসানা খাতুন চৌকি থেকে নামে। বুকের ভার হালকা হচ্ছে।
সোহরাব আলি বলে, বুঝলে ওর কথা?
আমার সব বোঝা হয়ে গেছে গো। তুমি বোঝনি?
বুঝেছি। আমরা রিফিউজি আর ওরা সংখ্যালঘু। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা এমন দুধরনের মানুষ তৈরি করেছে। মানুষের ভেতরে মানুষ।
কথা শেষ করে সোহরাব আলি গম্ভীর হয়ে যায়। একটু থেমে আবার বলে,
এদের কথাবার্তাই আলাদা নীরু। বহরমপুরের মতো নয়। ওখানে আমরা এমন আন্তরিক টঙে কথা বলতে শুনিনি।
আমিও না। তুমি তো তোমার বাগান আর চিকিৎসা নিয়ে ভালো থাকবে। আমি এদেরকে নিয়ে থাকব। যাক এই বাড়ির মতো মানুষের আশ্রয়ও পাওয়া গেল। আমার ভালোই লাগছে।
খুশি মনে দুজনে বারান্দায় আসে। লম্বা বারান্দার এক কোণে পিড়ি পেতে খেতে দিয়েছে ওদের। জাফর হাত নেড়ে মাকে বলে, ভীষণ ভালো রান্না হয়েছে মা। তোমার রান্নার মতো নয়। একদম আলাদা।
মারুফ ওর পিঠে চাপ্পড় দিয়ে বলে, নতুন রান্না তো সেজন্য মজা লাগছে। রোজ খেলে লাগবে না।
আহ্, এমন করে বলতে হয় না মারুফ। ভাললাকে ভালো বলতে শেখো।
সোহরাব আলি মৃদু ধমক দেয়। আর কেউ কথা বলে না। হারিকেনের আলোয় পাঁচজনে গোল হয়ে খেতে বসে। এই পাঁচদিনে কারোই তেমন খাওয়া হয়নি। সবাই ক্ষুধার্ত ছিল। তাছাড়া কি দুর্যোগ পার হয়ে এসেছে সবাই ভেবেছিল ভাত হয়তো গলা দিয়ে নামবে না। বিশেষ করে আফসানার নিজেরই এমন ধারণা ছিল। কিন্তু খেতে বসে রান্নার স্বাদ খিদে বাড়িয়ে দিল। কিন্তু দেখা গেল গলা বুঝি আর সরু কোনো পথ নয়, ওটা চওড়া হয়ে গেছে। ভাত নামছে তো নামছেই। অনায়াসে প্রচুর ভাত খেয়ে ফেলল।
খাওয়া শেষ করে মালতীর দিকে তাকিয়ে বলে, এমন রান্না আমি কখনো খাইনি মালতী। এমন রান্না রোজ খেলে আমি হাতি হয়ে যাব।
সোহরাব আলি মৃদু হেসে বলে, তোমার কিছুই হবে না। নীরু। ওদের পেয়ে আমরা দুঃখ ভোলার জায়গা পেয়েছি।
আফসানা মালতীর দিকে তাকায়। লাবণ্যভরা চেহারা। অভাবে কাবু হয়ে আছে শুধু।
কিরে মালতী তুই যে কিছু বলছিস না?
মালতী কথা বলে না। মৃদু হেসে মাথার ঘোমটা বাড়িয়ে দেয়। কপালে সিঁদুরের ফোঁটা লেপ্টে গেছে। আফসানা খাতুনের মনে হয় ওর কপাল জুড়ে সিদুরের মেঘ। নতুন জায়গার সবকিছু ওর ভালো লাগছে। এমন অনেক দৃশ্য ও দেখতে পাবে, যা দেখে ও বারবারই এ দেশে আসার কষ্ট ভুলবে। একদিন এ দেশকেও আপন করে নেবে। ওর ছেলেরাও আপন করে নিয়ে এ দেশের জন্য যা কিছু করার তার সবটুকু করবে। ওহ! আফসানা খাতুন বড় করে শ্বাস টানে। সবাই তার দিকে তাকায়, কিন্তু কেউ তাতে কোনো প্রশ্ন করে না।
জাফর উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলে, হরেণ দাদা বলছিল আমাদের কোনো কষ্টই হবে না মা। এখানকার লোকজন সবাই খুব ভালো।
আফসানা খাতুন নিস্পৃহ কণ্ঠে বলে, সবাই কি কখনো ভালো হয় বাবা?
ঠিক বলেছো মা। সবাই ভালো হয় না। তবে মা বেশির ভাগ মানুষ। ভালো হয়। এই যেমন হরেণ দাদা, আর মালতী বৌদি আমরা কেমন লোক না জেনেই কত ভালোবাসার আয়োজন করেছে। আমাদের দুঃখ ভুলিয়ে দিচ্ছে। বলছে, দেখে দেশটা তোমাদেরই হবে।
জাফরের কথা শুনে আফসানা খাতুন চোখের জল মোছে। হাসিতে মুখ উজ্জ্বল করে বলে, আমাদের ভাগ্য যেন সব সময় এমন ভালোই থাকে রে আমার সোনার ছেলেরা।
আমাদের নিয়ে তোমার ভাবতে হবেনা। কি বললা বাবা? আমরা পারব ঠিকমতো দাঁড়াতে নিজেদের মতো করে অনেক বড় হতে?
জাফর খুশির স্বরে কথা বলে। সোহরাব আলি ঘাড় নেড়ে বলে, অনেক কঠিন কথা বলেছিস। আমাদের ছেলেরাই তো আমাদের আশা-ভরসা।
বাবা, বাবা!
দীপু বাবার গলা জড়িয়ে ধরে। বাবার চুলে নিজের মুখ ঘঁষে।
জাফর হাসতে হাসতে বলে, তোমার পাগলা ছেলে বাবা।
সবাই হাসে। মারুফ চুপচাপ, গম্ভীর। দীপু আর জাফরই হাসাহাসি, হৈচৈ করছে। ভালো লাগে ওদের এই প্রাণখোলা উচ্ছ্বাস। নিজের বাড়িঘর থেকে বিতাড়িত হয়ে আসার বেদনা ওরা কাটিয়ে উঠছে। ওরা আপন করে নিচ্ছে নতুন পরিবেশ। খাওয়া-দাওয়ার পর কিছুটা নির্ভার মন নিয়ে। ঘুমোতে যায় আফসানা খাতুন। সোহরাব আলি বাগানের দিককার বারান্দায় এসে বসে। এক ঝলক ঠাণ্ডা বাতাস বুকে টানে। বাতাসে কামিনী ফুলের গন্ধ মেশানো। তাঁর ভালো লাগে। এই নতুন পরিবেশে নিজেকে উদ্বাস্তু মনে হচ্ছে না, মনে হচ্ছে না অবাঞ্ছিত, এই ভাবনা সোহরাব আলিকে শক্তি যোগায়। তেমন শক্তি যাকে ভর করে একজন মানুষ বিপর্যয় কাটিয়ে উঠে নিজেকে নতুন করে নির্মাণ করে। একটু আগে রিফিউজি হয়ে যাওয়ার যে ভাবনা ওকে তাড়িত করেছিল সে ভাবনা থেকে নিজেকে বিযুক্ত করে। ভাবে, দেশের জন্য কিছু করাটাই হবে সবচেয়ে বড় ঋণ পরিশোধ। তাছাড়া নিজের সামাজিক সম্মানটাও বড় করে তুলতে পারবে এভাবে। নিজের ভিটেমাটি থেকে চলে আসার অপমানও আর যন্ত্রণাদায়ক হবে না। সোহরাব আলি নিজের মুঠি দিয়ে চেয়ারের হাতল আঁকড়ে ধরে। যেন কোনো একটি শপথবাক্য উচ্চারণ করতে পারল এই মুহূর্তে।
রাস্তা দিয়ে দু-একটা রিকশা যাচ্ছে, টুংটুং বেল বাজে। দু-একজন মানুষের গলা শোনা যায়। ওরা হয়তো ঘরে ফিরছে। যেন কতকাল ধরে। ওদের একটি ঘর আছে এই শহরে। শহরটা ছোট। চারদিক খোলামেলা। যতটুকু দেখেছে তার মধ্যে এটুকু আন্দাজ করতে পেরেছে সোহরাব আলি। মানুষের কণ্ঠস্বর ওর বুকের ভেতর ওম ছড়ায়। তবে মানুষই তো হাতে ছোড়া-দা নিয়ে তেড়ে আসে। আবার মানুষই মুখে ভাত তুলে দেয়। চোখের দৃষ্টিতে বলে, বাঁচতে হবে। বেঁচে থাকার মতো জরুরি কাজ আর কি আছে? বেঁচে থাকলেই তো অনেক কিছু করার কথা ভাবা যায়। সোহরাব আলি চেয়ারে মাথা ঠেকিয়ে নিমগ্ন হয়ে শব্দ শোনেন। জাফর এসে কাছে দাঁড়ায়।