সোহরাব আলি আবার বলে, তুমি তো ঠিক আছো?
ঠিক? আফসানা খাতুন চমকে তাকায়। বিড়বিড় করে আবার বলে, ঠিক? আমার কি আর ঠিক থাকা হবে। আমার ফেলে আসা বাড়িঘর… সংসার…
আফসানা খাতুন আঁচলে মুখ ঢেকে গোঙ্গানির শব্দ করে। সোহরাব আলি দ্রুত কাছে এসে বলে, থাম নীরু থাম। ছেলে শুনতে পেলে মন খারাপ করবে।
।আফসানা খাতুন কান্না থামায়। আঁচল দিয়ে চোখ মোছে। শান্ত হয়ে বসে।
মারুফ, জাফর আর দীপু কুয়োতলায় হাত-মুখ ধুতে গেছে। ওরা জোরে জোরে কথা বলছে। নতুন দেশের পানি ওদের শরীর জুড়িয়ে দিচ্ছে, মন ভালো করে দিচ্ছে—এসব কথা বলছে। আফসানা খাতুন কান খাড়া করে আরো কিছু শোনার চেষ্টা করছে, কিন্তু কথা আর ভেসে আসে না। ভেসে আসছে ওদের হাসির শব্দ। আফসানা খাতুন স্বস্তি পায়। এতক্ষণে মনে হয় তার দম ঠিক হয়ে আসছে। ওটা আর কষ্টের কাঁটাতারে আটকে যাচ্ছে না। ছেলেগুলো আনন্দে আছে এটুকু শান্তিতে আফসানা খাতুন সোজা হয়ে বসে।
মালতী একটা হারিকেন জ্বালিয়ে দিয়ে গেল। ঘোমটার আড়ালে ওর চেহারা তেমন দেখা যায়নি। আফসানা খাতুনের একবার মনে হয় ওকে ডেকে এখানকার খোঁজ-খবর করে, কিন্তু পরক্ষণে তেমন ইচ্ছে হয় না। ফেলে আসা বাড়িঘর বুকের ভেতর এমন জমাট হয়ে আছে যে নতুনটা সম্পর্কে খোঁজখবর নেয়ার ফাঁক কৈ? বুকের ভেতর হাওয়া নেই বলে মুখে কথা সরে না। নাকি ছেলেদের হাসির শব্দ তাকে মনে করিয়ে দিচ্ছে যে দেশটাকে আপন করতে হবে। এটাই এখন তার বিকাশ। যেটা ফেলে এসেছে সেটা বুকের ভেতরে থাকবে। স্বপ্নের ভেতরে ডুবে যাবে কিংবা স্মৃতি রোমন্থনের সুযোগে নাক উঁচু করে বলবে, আমাদের কথা ভেবো। তোমার অতীত—তোমার রেখে যাওয়া জায়গা জমিন-গাছ-পাখি এবং মানুষ। ঠিক আছে, তোমরা তোমাদের মতো থাকো, শুধু আমাকে দিও না। আফসানা খাতুন বড় করে শ্বাস ফেলে। সোহরাব আলি চমকে তার দিকে তাকায়, কিন্তু তার মনে হয় কিছুক্ষণ আগে দেখা আফসানা খাতুনের সঙ্গে এই আফসানা খাতুনের মিল নেই। নতুন দেশে এসে এই প্রথম ও অন্যরকম মানুষ হয়েছে। সোহরাব আলি খুশি হয়। মনে মনে বলে, বড় একটি বিপদ কেটে গেছে। এখন আর বিপদের কথা মনে আসবে না। হাসিমুখে বলে,
আমরা শেষ পর্যন্ত প্রাণ নিয়ে আসতে পেরেছি নীরু।
আফসানা খাতুন মাথা নাড়ে। পিঠটা দেয়ালে ঠেকিয়ে নড়েচড়ে বসে, পা লম্বা করে দেয়। অনেকক্ষণ পর আফসানা খাতুন কিছুটা সহজ হবার চেষ্টা করে। হাসিমুখে স্বামীর দিকে তাকিয়ে বলে, এতক্ষণে মনে হচ্ছে কেউ আর আমাদেরকে ছুরি আর রাম-দা ধরে তাড়া করছে না। আমরা পালাচ্ছি না। আমাদের আশ্রয় জুটেছে।
ঠিক বলেছো। সোহরাব আলি চৌকির উপরে আফসানা খাতুনের পাশে এসে বসে। হাত ধরে বলে,
দীপেনের জন্যই সব হলো। ও যদি আমাদের বহরমপুরের বাড়িটার সঙ্গে এ বাড়িটা বদল করে না দিতে পারতো কি যে হতো?
এসব কথা এখন থাক। একটু বিশ্রাম নাও।
বহরমপুরের বাড়িটা আমার খুব প্রিয় ছিল। গাছ-গাছালি ভরা অমন বাড়ি হয় না। কত যত্ন করে গাছ লাগিয়েছিলাম। তুমি আমি মিলে গাছগুলো কত যত্নে বড় করেছিলাম। আমাদের বাড়িতে এমন অনেক গাছ ছিল যে গাছ গায়ের অন্য কারো বাড়িতে ছিল না। লোকে পথ দিয়ে যাবার সময় আমাদের বাড়ির ফুল গাছের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে যেত। বল ততা, ইস কি সুন্দর! তুমি আর আমি বাগানে বলে কতদিন এমন উচ্ছ্বাসের কথা শুনেছি। তাই না নীরু?
আফসানা খাতুন কথা বলে না। এমন কথার উত্তরে কথা বলতে তার ভালো লাগে না। এসব ফেলে আসা দিনের কথা দিয়ে কি এখনকার দিনগুলো ভরিয়ে রাখা যাবে? মানুষটা ওকে এভাবে গল্প শোনাবে। পুরনো দিনের গল্প এবং গল্প বলে দুঃখে-কষ্টে ক্লান্ত হয়ে যাবে। এই কথা ভেবে আফসানা খাতুনের মন খারাপ হয়ে যায়। সোহরাব আলি আবার কিছু একটা কথা বললে চুপ করেই থাকে ও। তখন শুনতে পায় স্বামীর কণ্ঠে ক্লান্তি। সোহরাব আলির কণ্ঠে ক্লান্তি।
তুমি চুপ হয়ে গেলে কেন নীরু?
কিছু ভালো লাগছে না। মনে হচ্ছে আরেকজনের সংসারে এসে ঠাই নিয়েছি। ওরা সব আসবাবপত্র হাঁড়িকুড়ি থালাবাসন রেখে গিয়েছে বলে আমরা আরেকটা খরচের ধাক্কা সামলাতে পেরেছি। তারপরও অন্যের সংসারের জিনিসপত্র এ কথা ভুলি কি করে!
থাক আর ভাবতে হবে না। খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়া। ভালো একটা ঘুম হলে শরীর ঝরঝরে লাগবে।
আফসানা খাতুন কিছু বলার আগেই হরেণ এসে দাঁড়ায়।
মা খাবেন এখন?
কি বেঁধেছে মালতী?
আমরা গরিব মানুষ, কি আর রাঁধবো মা? সরষে ইলিশ করেছি, চিংড়ি মাছ দিয়ে লাউ, পুদিনার চাটনি, ডাল। এই দিয়ে হবে তো খাওয়া?
কি যে বলো এত খাবো কি করে? মনে হচ্ছে তুমি আমাদের দাওয়াত খাওয়াচ্ছে। আমরা যে তোমার দেশে এসে পড়েছি। তাই না?
লজ্জা দিচ্ছেন কেন মা? আপনারা কতদূর থেকে এলেন, আমার ক্ষমতা থাকলে কত কি যে রাঁধতাম। আর এটা তো এখন আপনাদের দেশ। শুধু আমার দেশ তো নয় মা। আপনারা ঠাই দিলে আমরাও ভালো থাকব মা।
অকস্মাৎ হরেণের কণ্ঠ ভারী হয়ে যায়। চোখে জল আসতে চায়। ঢোক। গিলে সে জল ঠেকায়।
আফসানা খাতুন হরেণের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। মনে হয় একজন খুব কাছের মানুষ পাওয়া গেলো যার সঙ্গে মন খুলে কথা বলা যাবে। ওর একধরনের দুঃখ আছে। আফসানা খাতুন খুব দ্রুত ওর মনের কথা বুঝে যায়। দেশভাগ হওয়ার পর থেকে ভারতের মাটিতে মুসলমান হওয়ার জন্য ওরা তাড়া খেয়েছে। ওরা এ দেশে এখন শরণার্থী। আর এ দেশে হরেণ-মালতীরা তাড়া খেয়ে পালায়নি ঠিকই, কিন্তু শরণার্থী হয়ে গেছে। এই সত্য কাউকে বুঝিয়ে বলতে হবে না। আফসানা খাতুন দেখতে পায় হরেণ নিজেকে সামলে গিয়েছে। ওর ঠোঁটে চিকন হাসির রেখা উঁকি দেয় আর মিলিয়ে যায়।