সালমা অনবরত তলিয়ে যাচ্ছে। শব্দময় জগৎ থেকে নির্বাসিত ও। সালমার পৃথিবী এখন ঈভের স্বর্গোদ্যানের মতো আশ্চর্য ঐশ্বর্যময়।
০২. বাবা জাহিদ চৌধুরী মনে করে
বাবা জাহিদ চৌধুরী মনে করে, সালমা উর্বর জমির মতো। ভালো করে না চষলেও আশ্চর্য ফসল ফলে। মা মনে করে, সালমা মোহনার মতো প্রতিনিয়ত নতুন নতুন ধ্যান-ধারণার পলিমাটিতে ভর্তি হয়ে যায়। নইলে সারাক্ষণ এমন আজগুবি উদ্ভট চিন্তা ওকে পাগল করে রাখে কেন? নিয়মের ব্যতিক্রমটা ও বেশি ভালোবাসে। ওতেই আনন্দ পায়।
বাবা এবং মেয়ে। মা এবং মেয়ে। ভাই এবং বোন। সম্পর্কের এ নির্ধারিত বেড়াজাল সালমার ভালো লাগে না। সম্পর্কের সূত্র ধরেই মানুষ মানুষের ওপর অধিকার খাটায়। প্রভুত্ব করার সাধ হয়। বাবা-মা ওকে কত ভালোবাসে। অন্য আরো দশজন বাবা-মার চাইতেও বেশি। আর বেশিটাই সালমার মনে হয় বাড়াবাড়ি। মনে হয়, তারা তাদের অধিকারের সীমা লঙ্ঘন করছে।
সালমার মনে হয়, মানুষ যখন এত কিছু স্বীকার করে একটি অন্ধ অবস্থানের মধ্যে বসবাস করে তখন সেটা তার জন্য এক চরম লজ্জাকর। অসুস্থতা। নইলে সম্পর্কের এ বেড়ি কেউ ভাঙে না কেন? কেন নিজের অবস্থান সম্পর্কে প্রশ্ন তোলে না? বাবা-মা তাদের সম্পর্কের গণ্ডিতে নিশ্চিত। সাকিবেরও একই অবস্থা। নির্ভাবনাময় জগতে ঘুমিয়ে আছে যেন। পরিবেশ এবং অবস্থানকে প্রশ্ন না করার অর্থ আপন সত্তাকে উপেক্ষা করা। সালমার বুকটা আবার ধড়ফড় করে। কোনো কিছু নিয়ে চিন্তার বুনট ঘন হয়ে জমতে থাকে। আসলে প্রত্যেকেরই নিজ নিজ অভিরুচি দিয়ে আপন স্বভাব গড়ে তোলা দরকার। উত্তরাধিকারসূত্রে সমাজের কাছ থেকে পাওয়া সংস্কারের কাছে নিজেকে সমর্পণ করতে হবে এমন শর্ত তো কেউ দেয়নি। তবে এত সহজে সবকিছু গ্রহণ করে নির্বিবাদ হয়ে যাওয়ার কী মানে থাকতে পারে। সংসার সমাজ পৃথিবী মানুষের হাতে কিছু পৌঁছে দেয় না। সকালবেলা উঠে কেউ দেখে না দরজায় তার জন্য সোনার গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে–সব পেয়েছির দেশে তাকে নিয়ে যাবে। আসলে আপন পরিকল্পনা এবং কাজ দিয়ে সবাইকে ক্ষেত্র তৈরি করতে হয়। সারা জীবনের পরিশ্রমে সে জমিতে ফসল ফলে। মানুষের এই একক সত্তায় যখন অন্যের প্রতিফলন নেই, তখন সম্পর্কের বাঁধন এত শক্ত করার দরকার কী?
আমি চাই নিজের কাছ থেকেও মুক্ত থাকব। সালমা ভাবল। আমি চাই প্রতি মহর্তে নিজেকে অতিক্রম করে চলতে। আমার এই মানবীর চাই প্রতি মুহূর্তে নিজেকে অতিক্রম করে চ চৈতন্যের জগৎই আসল। এছাড়া আর কোনো জগৎ নেই। সালমার নসিয়া তীব্র হয়ে ওঠে। কৌটা খুলে এলাচদানা মুখে দেয়। ফুল স্পিডে ফ্যান ছাড়ে। ভীষণ গরম লাগছে। দরজা বন্ধ করে গায়ের কাপড় খুলে ফেলে। সারা গায়ে গরম স্রোত বয়ে যাচ্ছে যেন। হাঁসফাঁস করে সালমা। কী যন্ত্রণা! বাইরে কাকটা বিশ্রী শব্দে ডাকছে। ওটার গলা টিপে ধরতে ইচ্ছে করে। এমন কর্কশ কণ্ঠ? সুখ-দুঃখের কথা মনে হয় সালমার। ওরা কী করছে? ওরাও কি সালমার মতো গায়ের কাপড় খুলে ফেলেছে? ধুৎ, বাজে ভাবনা! সালমা ঠাণ্ডা মেঝের ওপর বালিশটা বুকে চেপে শুয়ে থাকে। বাবার কথা মনে হয়।
বাবা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। দর্শনের অধ্যাপক। সালমাও ওই একই বিষয়ে পড়ে। বাবা যা পড়ায় সালমা তা বোঝে না। বাবার লেকচার মনে হয় ষাঁড়ের চিৎকারের মতো। সালমার একদম ভালো লাগে না। মাঝে মাঝে মনে হয় আসলে বাবা কিছু জানে না। জানে না বলেই গর্জনটা বেশি। সালমা ভেরে পায় না যে বাইরের লোকেরা বাবাকে পণ্ডিত বলে কেন? তিনটে-চারটে ডিগ্রি আছে বলে। শুধু ডিগ্রি থাকলেই একজন লোক শিক্ষকতার অধিকার অর্জন করে। সালমা হিসাব করে দেখল যে বাবার নিজের জীবন অসংখ্য গলদ এবং ত্রুটিতে ভরা। তার কথা এবং কাজে কোনো সামঞ্জস্য নেই। বাবা খ্যাতির মোহে পাগল। টাকার মোহে পাগল। এর বাইরে বাবা ভালো কিছু চিন্তা করতে পারে না। একটি লোক এত ত্রুটি নিয়ে অন্যকে কী শেখাবে? শিক্ষকতা করার তার কোনো অধিকার নেই। নিজের সঙ্গে আপস করে যে নিজের চরিত্রকে নোংরা করেছে তার কাছ থেকে অন্যে কী শিখবে? বাবার কী অধিকার আছে শিক্ষকতা করার? জীবিকা নির্বাহের জন্য তিনি অন্য কিছু করতে পারেন। শিক্ষকতা নয়। সালমার বুকটা ধক করে ওঠে। আসলে বাবা চরিত্রহীন। এই শব্দটা বাবার চরিত্রের মেজাজের সঙ্গে হুবহু মিলে যায়। এসব কথা ভাবতে গেলে ঠাণ্ডা মেঝেয় শরীর শীতল হয়ে আসে।
অথচ বাবা-মা নাসিমাকে দিন-রাত চরিত্রহীন বলে গাল দেয়। স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে যাবার পর নাসিমা বিয়ে ছাড়াই আরেকজনের সঙ্গে বসবাস করে। এটা তার অপরাধ। অনেকের মতে নাসিমা অ্যাবনরমাল। একদিন সালমা এ প্রসঙ্গ উঠিয়েছিল।
নাসিমা’পা, কেউ কেউ বলে তুমি নাকি অ্যাবনরমাল?
রেগে গিয়েছিল নাসিমা। ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেছিল, যে প্রতি পদে পদে নিজের সঙ্গে আপস করে তোরা তাকে বলিস নর্মাল। সেই তো সবচেয়ে বড় অ্যাবনরমাল। কেননা সে নিজের মতো করে বাঁচতে জানে না। তার নিজস্ব কোনো পরিচয় নেই। আমি নিজের মতো করে বাঁচতে জানি বলেই আমি অ্যাবনরমাল, তাই আমাকে নিয়ে এ সমাজের মাথাব্যথা।
নাসিমার কথাগুলো নিয়ে সালমা অনেক ভেবেছে। ভেবে কুলোতে পারেনি। তার বাব-মার অযাচিত মন্তব্যও সালমার ভালো লাগে না। কারো সম্পর্কে মন্তব্য করার আগে নিজের চরিত্রটা অন্তত একবার যাচাই করে দেখা উচিত। মানসিকতার কোন অ্যাঙ্গেল থেকে কথা বলবে সেটা যদি মাপা না থাকে তবে ব্যক্তি হিসেবে তার কিসের মহত্ত্ব? বাবা নিজেকে অতিক্রম করতে পারেনি। আপন সীমিত গণ্ডির মধ্যে ঘুরে মরে। যত অসাধারণ পণ্ডিত ব্যক্তিই হোক নিজেকে যে অতিক্রম করতে পারে না তার কোনো মহত্ত্ব থাকে না। সালমা হাঁপিয়ে ওঠে। ভাবতে ভাবতে সব গুলিয়ে যায়।