একই সঙ্গে বাবাও বেরিয়ে গেল। কাঠের গেটটা খোলা। বাবা বন্ধ করেনি। সালমা উঠে বন্ধ করে এলো। বাতাসে হলুদ পাতা উড়ে যাচ্ছে। খয়েরি পাখি কলাবতীর ঝোপে ডানা মেলে গুটিয়ে নেয়। নিজস্ব ইচ্ছের খেলা। সালমার এখন নিজের সঙ্গে খেলতে ইচ্ছে করছে, এলোমেলো খেলা। ছছাটবেলার মতো। হাঁটতে হাঁটতে সিঁড়ির ধারে এলো। সাব্বির ভাই নেই। নাসিমা আপার ঘরে উঁকি দিয়ে আসি। কী করছে নাসিমা আপা? নিশ্চয় বারান্দায় পা ছড়িয়ে বসে ম্যাগাজিন পড়ছে। কত যে পড়তে পারে। পড়তে একটুও ক্লান্তি লাগে। না নাসিমা আপার।
সালমা পা টিপে টিপে সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেল। সামনের দরজা মুখে মুখে লাগানো। আস্তে করে ঠেলে ভেতরে ঢুকল সালমা। না, ড্রইংরুমে কেউ নেই। ফ্রিজের মুখ খোলা। মেঝেয় সিগারেটের টুকরো ছড়ানো। অ্যাশট্রে ভর্তি। টেবিল-ক্লথ সোফার ওপর। ফুলদানি উল্টে আছে। সালমা নাক কুঁচকাল। পরিপাটি সাজানো ঘরটা কেমন বিশ্রী করেছে ওরা। নিশ্চয় সাব্বির ভাইয়ের কাজ। সালমা ঘুরেফিরে হতাশ। ভাবল, চলে যাবে। অপরাধী মনে হচ্ছে নিজেকে। এভাবে অন্যের ঘরে ঢোকা ঠিক নয়। আবার কৌতূহল হলো। নাসিমা’পা কী করছে? সাড়াশব্দ নেই কেন?
সালমা পর্দা সরিয়ে বেডরুমে উঁকি দিল। শিরশিরিয়ে উঠল অনুভূতি। সালমা দেখল। একবার। দুবার। তিনবার। চোখ বুজে শুয়ে আছে নাসিমা। না, ঘুমোয়নি। শুয়ে শুয়ে হাতের আঙুল নাচাচ্ছে এবং নাসিমা’পা নগ্ন। সালমা যেমনি এসেছিল তেমনি নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল। উত্তেজনায় হাত-পা কাঁপছে। আঙুল কামড়াতে ইচ্ছে করছে। কেমন যেন লাগছে সালমার। ঝিমঝিম করছে মাথা। বারান্দায় বাবার ইজিচেয়ারটার ওপর বসে পড়ে। একটু পরে সাব্বির সিঁড়ি দিয়ে উঠে। গেল। মুখের দিকে তাকায় না সালমা। আড়চোখে দেখল, হাতে ডানহিলের প্যাকেট। লাল রঙের সেই প্যাকেটটা অবিকল রকিবের মুখ হয়ে গেল। সালমার রক্তের লোহিত কণিকায় রকিবের নিঃশ্বাস বয়ে। যায়। ঘুম পায় ওর। কেমন সহজে ঘুম আসে। আশ্চর্য, সালমা ঘুম চাচ্ছে না, তবু ঘুম আসছে। স্বচ্ছন্দে ও তরতরিয়ে সালমার চোখের কূলে এসে ভিড়ছে ঘুমের তরী। সালমা বিড়বিড় করল, রকিব তুই কতবার আবাল খেলা খেলেছিস–রকিব তুই কি সুখ পেয়েছিস–নাসিমা’পার বোজা চোখে-নগ্ন বুকে নৃত্যরত আঙুলের ডগায় আমি নীল সুখ দেখেছি–রকিব তুই জানিস না আমার কেমন যেন লাগছে।
রকিব তুই কতজনের সঙ্গে আবাল খেলা খেলেছিস? কতজন–রকিব কতজন–কতবার–রকিব কতবার ক-ত-বা-র। কতরাত কতদিন তোর খুব কষ্টে কেটেছে রকিব। তুই অনেকবার সে গল্প করেছিস। জানিস আমার ইচ্ছে তুই আর আমি একদিন চলে যাব আমার সেই নির্জন দ্বীপে। শুধু তুই আর আমি। আর কেউ না রকিব। আর কেউ না। এমনকি আমাদের ইচ্ছেগুলোও আমাদের সঙ্গে নেব না। পোশাকের মতো সমস্ত ইচ্ছে, আকাক্ষা, বাসনা ঝেড়ে ফেলে দিয়ে মানুষ নগ্ন হতে পারে না। বল না রকিব, পারে কি না? নাসিমা’পার মতো শুধু পোশাক খুলে নয়, আমি তেমন ন্যাংটো হতে চাই, যা আমাকে একদম বদলে দেবে। একদম অন্য মানুষ হতে পারলে জীবনটাকে বেশ উপভোগ করা যায়, কি বলিস? ধর, তুই সালমা হলি আমি রকিব? তাহলে কেমন হবে? মনে হবে না আমরা নতুন সৌরমণ্ডল গড়তে পেরেছি? নাসিমা’পা বড় অল্পে সুখ পেয়েছে। আমার তা ভালো লাগেনি। ওটাকে সুখ বলে না। এটা হলো ইচ্ছের দাসীগিরি করা। ধুৎ, বাজে! ওই নীল সুখ আমি চাই না। আমি আরো গভীরে যেতে চাই রকিব। আরো গভীরে। সে তলায় গিয়ে যেন আর ঠাঁই না পাই।
রকিব, তুই আমাকে নিয়ে যাবি সেই দ্বীপে? আমি যাব। স্লোমোশন ছবির মতো যাব। নিঃশব্দে। ভেসে ভেসে। আঃ, কী আনন্দ! সুখ পেতে হলে সুখের মতো করে পেতে হবে। একটু সুখে তৃপ্তি নেই। স্থূল হয়ে যায়। তুই আর আমি আলাদা জগৎ গড়ব। নিয়ম ভাঙব। সুখের রং দেব। পাখির ডাক বদলাব। গাছের পাতা বানাব। আমরা বিধাতার মতো হব। সৃষ্টির আনন্দে মাতব। আরো কত কী রকিব! কত কী!
সালমা চোখের পাতা খুলবার চেষ্টা করে। পারে না। ওপরে নিচে কে যেন আঠা লেপে দিয়েছে। সালমা বুঝতে পারছে পারিপার্শ্বিক নির্জন হয়ে যাচ্ছে। পশ্চিম আকাশে কাত হয়ে পড়া সূর্যের একফালি রোদ। সালমার পায়ের ওপর এসে পড়েছে কিসের মিনতি জানায়? সালমা। আস্তে আস্তে ঘুমের প্রশান্ত সমুদ্রে ড়ুবে যাচ্ছে। সালমার গোলাপি ঠোঁটে নীল সুখ কাপে। এবং মনে হয় নিজের মধ্যে কোথাও কোনো ভার নেই। সালমা একদম ন্যাংটো হয়ে গেছে। সে বোধের সঙ্গে সঙ্গে ওপরের দরজা বন্ধ হয়ে যায়। কোথাও আর কোনো সাড়া নেই। সালমার নির্জন পৃথিবীতে ও একা।
বাগানে রোদের লুটোপটি। কলাবতী ঝোপ থেকে টুনটুনি উড়ে গেছে। হলুদ প্রজাপতিও নেই। আনুর মা রান্নাঘরের বারান্দায় আঁচল পেতে শুয়ে আছে। জলিল মিয়া কামিনী গাছের নিচে বসে বিড়ি টানে। দুপুরে ঘুম আসে না ওর। করতোয়া পাড়ের ছেলে সহজে অলস হয় না। কাঠের বাক্সের ভেতরে সালমার সুখ-দুঃখ একে অপরের গাঁয়ে মুখ ঘষে। জড়াজড়ি করে শুয়ে থাকে। বাটি থেকে দুধ খায়। অথবা তারের ওপর মুখ রেখে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকে। আম, নিম, আমড়ার পাতা ফস করে জ্বলে ওঠা দিয়াশলাইর কাঠির মতো টুপ করে ঝরে যায়। বেদনাহীন ঝরায় কোনো আলোড়ন নেই।
ওপরের ঘরে সাব্বির আবার দরজা লাগিয়েছে। ড্রয়িংরুমে আরো সিগারেটের টুকরো জমেছে। জানালার হলুদ পর্দার শরীরে বাতাসের কাঁপন। নাসিমার নগ্ন বুকে নীল সুখ থির থির করে। সুখ আস্তে আস্তে গাঢ় হয়। গাঢ় থেকে প্রগাঢ়। সাব্বিরের হাতের সিগারেট নিঃশেষ।