তোমার ঘুম পাচ্ছে লিমা?
না তো।
সালমা তাড়াতাড়ি সোজা হয়ে বসে। বাবার সামনে ধরা পড়ে গেছে। একটু লজ্জাও পায়।
তুমি কিছু খাচ্ছ না?
খাচ্ছি।
দিন দিন কেমন শুকিয়ে যাচ্ছ?
তোমরা আমাকে নিয়ে বেশি ভাবো।
ভাবব না, তুমি আমাদের একটা মেয়ে—
আমার ভালো লাগে না।
বাবা একটু থমকে ওর মুখের দিকে তাকায়। সালমা চোখ নিচু করে। পরপর কয়েক গ্রাস ভাত মুখে গুঁজে দেয়।
অমন করে খায় না লিমা।
সালমা কথা বলে না। বাবার কণ্ঠ নরম শোনায়। বুকের ভেতরের একটা নির্দিষ্ট স্থান থেকে সে কথাগুলো উঠে আসছে। যে স্থানটা শুধু সালমার জন্য। আর কারো জন্য নয়।
তোমার কী ভালো লাগে বলো তো মা?
আমি চাই তোমরা কেউ আমার জন্য যেন বেশি না ভাবো।
আচ্ছা।
বাবার মুখটা অপরাধী দেখায়।
প্লেটের অবশিষ্ট ভাতগুলো চটপট খেয়ে ফেলে। জলিল মিয়া মিষ্টির বাটি রেখে যায়। খাওয়ার পর, মিষ্টি না খেলে বাবার ভাত হজম। হয় না। অথচ সালমা খুব বেশি মিষ্টি খেতে পারে না। মিষ্টি খেলে নসিয়ার মতো লাগে।
তুমি না বলছিলে, তোমার কোথায় যাবার তাড়া আছে।
হ্যাঁ, একটা মিটিং আছে।
বক্তৃতা করবে?
সালমার চোখে সকৌতুক হাসি।
দেখো না, ওরা আমাকে সভাপতি করে ছাড়ল। আমার একদম ইচ্ছে ছিল না। আমি না করেছিলাম, তা ওরা শুনলই না। বাধ্য হয়ে এখন যেতে হবে।
বাবা এমন একটা ভাব করল যেন ভীষণ অনিচ্ছায় যাচ্ছে। এসবের প্রতি তার কোনো মোহ নেই। সালমা ঠোঁট বাঁকায়। কিছু বলে না। সভা সমিতি বক্তৃতা ইত্যাদির প্রতি বাবা ভয়ানক দুর্বল। কেউ না ডাকলেও জোর করে যেতে চায়। কোনো সভা থেকে বাদ পড়লে রেগে যায়। বলার সময়ে বাবা কি না বলে জোর করে ধরল। বাজে কথা। এটুকু শুধু বলার জন্য বলা। সালমা তো চেনে ওর বাবাকে। বাবার বক্তৃতার কোনো অর্থ ও খুঁজে পায় না। নিজের জীবনের সঙ্গে যার কোনো যোগ নেই সেইসব বড় বড় কথা বাবা চমৎকার সাজিয়ে বলে। মানুষ এমন অবলীলায় কেমন করে মিথ্যে কথা বলে এটাই বুঝতে পারে না সালমা। বাবাকে না দেখলে ও হয়তো বিশ্বাসও করতে পারত না মানুষের। মুখোশপরা চেহারার আদল ভিন্ন। নিজে যা বিশ্বাস করে না অপরকে তা বোঝাতে চেষ্টা করে। শুধু হাততালি পাওয়ার জন্য সব ধরনের বুলি এরা কপচাতে পারে। একটুও ভেবে দেখে না কতটুকু বলা ঠিক হলো। সালমা প্রথম প্রথম বাবার সঙ্গে যেত। এখন যায় না। বাবাও নিতে চায় না। কেননা বাসায় এসেই সালমা বাবার সঙ্গে তর্ক জুড়ে দেয়। নাজেহাল করে। বাবা বিরক্ত হয়। সালমার চিন্তার খেই ছিড়ে বাবা চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়ায়। বাবা বারান্দার বেসিনে হাত ধুচ্ছে। সেই সময়টুকু অপেক্ষা করে সালমা। বাবা ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে টুক করে উঠে পড়ে।
আনুর মা অভিযোগ করে।
আপনি কিছু খাননি আপামণি।
ধুৎ, সবার মুখে কেবল এক কথা! বেশি খাও আর বেশি খাও। সালমা গজগজ করতে করতে বেরিয়ে যায়। নিজের ঘরে চলে আসে। ঘুমোতে পারলে মন্দ হতো না। কিন্তু ঘুম কি আসবে? ঘুমটাকে কিছুতেই। বাগে আনতে পারে না ও। সাজু বলে ঘুমের ওপর ওর নাকি আশ্চর্য দখল। ইচ্ছে করলে দুমিনিটের মধ্যে ঘুমিয়ে যেতে পারে। ঘুমুবার আগে পাঁচটার সময় উঠব মনে করে, যদি ঘুমোয় ঠিক পাঁচটায় ঘুম ভেঙে যায়। ফানি! কেমন করে সম্ভব? আর সালমা ঘুমুতে চাইলেই ঘুম পালায়। পঁচিশ মিনিট এপাশ-ওপাশ করার পর তারপর যদি ঘুম আসে। বিছানার ওপর শুয়ে শুয়ে পা দোলায় ও। দাঁতের নিচে এলাচের দানা। ঝাল ঝাল। মিষ্টি স্বাদ।
লিমা? ও লিমা?
আসছি।
বাবার এই এক অভ্যেস। কারণে-অকারণে সালমাকে শুধু ডাকবে। সালমা যত দূরে যেতে চায় বাবা তত কাছে টানতে চায়। মাঝে মাঝে রাগ হয়। ইচ্ছে করে জবাব দেয় না। কিন্তু এ করেও কি উপায় আছে! বাবা জোরজবরদস্তি করে কেবল। সালমা যেন একটা ঘোড়া। বাবা তাতে লাগাম জুড়ে রেখেছে। টানলেই দৌড়াতে হবে। বোগাস, সম্পর্কের অধিকার-টধিকার সব বোগাস। সম্পর্ক একটা আছে বলেই তো এত জোর খাটানো।
লি-মা-
কী বলছ?
দেখো তো মা, আমার ডায়রিটা কোথায়।
এই তো টেবিলের ওপর।
ওহ হো খুঁজে পাচ্ছিলাম না। দিন দিন কেমন ভুলো মন হয়ে যাচ্ছে আমার।
সালমা মনে মনে হাসল। ভুলো না ছাই। আসল জিনিস তোমার ঠিকই মনে থাকে। নিজের স্বার্থের ব্যাপারে তুমি কখনো ভুল করো কি। না বুকে হাত দিয়ে বলো তো দেখি? জানি উত্তর পাব না। ওই একটি ব্যাপারে তুমি খুব পারদর্শী। ভীষণ নিখুঁত। তুমি ঠিক জানো কোন। চালটা দিলে রাজাকে কায়দা মতো চেক দিতে পারবে। আমি তোমাকে এ পর্যন্ত ভুল করতে দেখিনি বাবা। আর তুমি কি না বলো সব তোমার ভুল হয়ে যায়। হাসতে গিয়ে সালমা আবার গম্ভীর হয়ে গেল। বাবা টাইয়ের নট ঠিক করছে। সালমা টেবিলে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। বাবাকে দেখে।
জলিলকে একটা রিকশা ডাকতে বলো মা?
তোমার গাড়ি?
ওয়ার্কশপে দিয়েছি।
ও।
সালমা বেরিয়ে যায়। জলিলকে রিকশা ডাকতে বলে সিঁড়ির ওপর। দাঁড়িয়ে থাকে। কড়া দুপুরে ঝাঁ ঝাঁ রোদ চারদিকে। দূরের কোনো গাছ থেকে ঘুঘুর ডাক ভেসে আসছে। এখন বাবা বেরিয়ে যাবে। বাড়িটা আবার শব্দহীন হবে। সালমা ড়ুবে যাবে অন্তরের চোরাবালিতে। ডান পাশের দোতলার সিঁড়ি দিয়ে সাব্বির ভাই নামছে। শার্টটা কুঁচকে গেছে। মাথার চুল এলোমেলো। সালমার দিকে এক পলক তাকিয়ে মুখ ঘোরাল।
কোথায় যাচ্ছেন সাব্বির ভাই?
রাস্তার মোড়ে। সিগারেট আনব।