ধক্ করে ওঠে বুক। সেই সঙ্গটুকু লাগে, যা মানুষের অস্তিত্বের বিকাশ ও স্থিতি দীর্ঘ করে। সালমার তখন কিছু ভালো লাগে না।
ওই সঙ্গটুকু জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে খেলতে ইচ্ছে করে। খেলতে ক্লান্তি নেই। রকিব বলে, যতই তুই না বলিস ঘুরেফিরে কিন্তু ওই এক জায়গাতেই এসে দাঁড়াতে হবে তোর। জানিস সালমা, আমার ভাইয়ের ছোট্ট মেয়েটাকে নিয়ে মাঝে মাঝে মজা করি। ওকে ওপর দিকে ছুড়ে দিয়ে বুকের মধ্যে লুফে নিই। ও বেশ আনন্দ পায়। খিলখিলিয়ে হাসে। আমাকে কিছুতেই থামতে দিতে চায় না। আমি থেমে গেলেই বলবে, কাকু আবাল। এও সেই আবাল খেলা সালমা। ভীষণ মজা।
সালমা চট করে জিজ্ঞেস করেছিল, তুই কখনো খেলেছিস রকিব?
রকিব মুখটা লাল করে বলেছিল, হ্যাঁ।
হয়তো সালমার সামনে খুব সহজে বলতে চেয়েছিল বলে মুখ লাল হয়েছিল। অথবা সালমাকে মিথ্যে বলতে চায়নি। কিংবা সালমার সামনে নিজের পৌরুষ জাহির করতে চেয়েছিল। সে যাই হোক, রকিবের উত্তরে সালমার মন খারাপ হয়নি। হাতে-পায়ের গিটে গিটে কেমন একটা অবসাদ জড়িয়ে থাকে। কেমন বিষণ্ণ চোখে রকিবের দিকে তাকিয়েছিল। বুঝতে চাইছিল, কোথায় রকিবের সুখ আটকে আছে। না, খুঁজে পায়নি সালমা।
তুই কার সঙ্গে খেলেছিলি রকিব?
তুই তাকে চিনবি না।
বল না কে?
বড় ভাবির ছোট বোন।
কোথায় খেলেছিলি?
নৌকায়। একদম মাঝ নদীতে।
কেমন করে পেলি?
ওকে শ্বশুরবাড়ি থেকে আনার জন্য একবার আমাকে পাঠানো হয়েছিল।
তুই সুযোগের ব্যবহার করেছিস?
মানুষে তো সারাজীবন ধরে সুযোগই খোঁজে সালমা।
সালমা আর কথা বলতে পারেনি। অনেক নাড়াচাড়া করেছে। রকিবের কথা নিয়ে। মানুষ সুযোগ খোঁজে। সুযোগ পেলে ঘটনা ঘটায়। আর অন্যজন সেই ঘটনার শিকার হয়। ভালো এবং মন্দ দুই অর্থেই ঘটনার শিকার হয়।
হঠাৎ সালমার খরগোশ দুটো দৌড়ে সালমার কোলের কাছে চলে আসে। ওর শাড়ির নিচ থেকে ভয়ে ভয়ে মুখ বাড়ায়। সালমা চারদিকে তাকায়। কী কারণে ওরা ভয় পেল? ছোট পেয়ারা গাছটার তলায় একটা বেজি মাথা উঁচিয়ে আছে। ও হাততালি দিতেই পালিয়ে যায়। খরগোশ দুটো কিছুতেই আর বেরোতে চায় না। নিরাপদ আশ্রয়ে দিব্যি বসে থাকে। সালমার বুকটা কেমন করে। সুখ-দুঃখ এমন করেই বুকের মধ্যে আশ্রয় খোঁজে। ঘটনা এসে বারবার তা বানচাল করে তোলে। কখনো এপাশে দোলায়, কখনো ওপাশে। নির্জন বাগানটার আপন বৃত্তে। সালমার খেলা জমে ওঠে। সমস্ত অনুভূতি আর আবেগ নিয়ে খেলা। কখনো ঘুম পায়। ভীষণ অবসাদে এলিয়ে পড়ে। যখন সজাগ হয় ফালি ফালি করে চিরে দেখে নিজেকে। কোনো সূত্র খুঁজে পায় না। বিষাদ, হতাশা–এমনি আরো কতকগুলো বাজে শব্দতাড়িত ভাবনা কাত করে ফেলে। আঙুর গাছের লতায় টুনটুনি লাফায়। বাংলাদেশের মাটি বলে অসম্ভব টক আঙুর। খাওয়া যায় না। বাড়িওয়ালার খুব শখের গাছ। সেজন্যে সালমাও যত্ন করে গাছটার। দোতলার জানালায় নাসিমার হলুদ পর্দা কাঁপে। ইংরেজি গান ভেসে আসছে। হয়তো এতক্ষণে নাসিমা আপাও এসে গেছে। ওরা এখন কী করছে? সালমা ভাবতে চাইল। ভাবতে পারল না। ভীষণ লজ্জা পেল।
আপামণি? ও আপামণিও সারাবাড়ি আপনাকে খুঁজছি।
কেন?
স্যার ডাকে।
আসছি।
বাবা ফিরেছে। বাবাকে স্যার ডাকে জলিল মিয়া। করতোয়া পাড়ের ছেলে শহরে এসে স্যার ডাকা শিখেছে। বাবা কখন ফিরল? গাড়ির শব্দ তো পায়নি সালমা। কটা বাজে? সূর্যটা খাড়া মাথার ওপর। গাছগাছালির ছায়া বলে তেমন জোরালো বোদ নয়। মাঘের শেষ। দিনরাত পাতা পড়ে। সালমার নির্জন পৃথিবীতে হলুদ পাতা বিছিয়ে আছে। জলিল মিয়া একবার করে পরিষ্কার করে। পায়ের নিচে মচমচ করে পাতা। এবং সালমা ইচ্ছে করে এক একটা শুকনো পাতার ওপর পা দেয়। মচমচ শব্দ শুনতে বেশ লাগে। মনে হয়, আদিম পৃথিবীর প্রথম ধ্বনি। সমস্ত মাটি কাঁপিয়ে উঠে আসে। অথচ কত মৃদু! সেতারের মতো।
সালমা ওর সুখ-দুঃখকে কাঠের বাক্সে ঢুকিয়ে দেয়। সবসময় ছেড়ে রাখে না। ছেড়ে রাখলে বেজির ভয়, বনবেড়ালের ভয়। আরো কত কী! পাশের বাসার দুষ্ট ছেলেটার ভীষণ লোভ এ দুটোর ওপর। ঘাসের শীতল শরীরের স্পর্শ নেবার জন্য সালমা স্যান্ডেল জোড়া হাতে নেয়। তারপর অকারণে একবার সারা বাগানটা বেড়ায়। মন্দ না। মনে মনে বলে, আমি বৃত্ত তৈরি করছি এবং তাকে প্রদক্ষিণ করছি।
আপামণি?
জলিল মিয়ার বিরক্ত কণ্ঠ।
বললাম তো আসছি।
স্যার খাবার টেবিলে বসে আছেন।
সালমা কথা না বলে পা বাড়ায়। অসহ্য! নিজের ইচ্ছেমতো কিছু করার জো নেই। কোথাও না কোথাও বাধা পড়বেই পড়বে। যত্তসব। বাগান পেরিয়ে গাড়ি-বারান্দা। সামনে লন। লনের একপাশ দিয়ে ঘরে ওঠার সিঁড়ি।
সালমা বাথরুমে গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে নেয়। খাবার ঘরে ঢুকে দেখল বাবা গম্ভীর মুখে বসে আছে। এখনো খাওয়া শুরু করেনি। সালমাকে দেখে প্লেট টেনে নিতে নিতে বলে, কী করছিলে?
কিছু না।
আমার আবার তাড়াতাড়ি বেরোতে হবে।
তুমি খেয়ে নিলেই পারতে।
তুমি জানো, তোমাকে ছাড়া আমি খাই না। তাছাড়া তুমি যখন বাসায় রয়েছ।
মনে করতে আমি বাসায় নেই।
কী যা তা বলছ!
বাবার কণ্ঠস্বরে বিরক্তি। সালমা চুপ করে যায়। ভাবে মনে করা না করার মাঝ দিয়েই তো একজনের অস্তিত্ব উড়িয়ে দেওয়া যায়। যায় না? ও যদি এখন চোখ বুজে ভাবে যে বাবা নেই তাহলে কেমন হবে? এই করেই তো বাবাকে উপেক্ষা করা যায়। সালমা একটুক্ষণের জন্য চোখ বুজল। দেখল যে, না, হয় না। কিসের যেন শব্দ হতে থাকে। সেই শব্দ অস্তিত্বের জানান দেয়।