সালমা মনে মনে হেসেছিল। দুর্ঘটনা ঘটলেই বা কী হতো? প্রতিটি মানুষই তো এক একটি ঘটনার শিকার। ঘটনার বাইরে কি কেউ থাকতে পারে? মানুষের সমস্ত জীবনটাই তো একটা ঘটনা। আর ঘটনা ঘটানোর মধ্য দিয়েই নতুন মূল্যবোধ গড়ে ওঠে–অপরিচিত অজানা বিশ্বকে নিজের কাজের মাঝে পরিচিত এবং অর্থপূর্ণ করা যায়। নিজের ইচ্ছেকে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়েই তো মানুষ ঘটনা ঘটায়। এই যেমন নাসিমা আপা। বাবুই পাখির মতো চমক্কার এক ঘটনার বাসা বুনে তার মধ্যে ড়ুব দিয়ে আছে। কারো তোয়াক্কা করে না। নিজস্ব মূল্যবোেধ বিশ্বাসী। তাতে কার বা কী এসে গেল? সালমার বাবা-মা নৈতিকতার দোহাই দিয়ে যত চেঁচাক, সালমার মনে হয় নাসিমা আপা একটা কিছু করতে পেরেছে। অন্তত নিজের ইচ্ছেমতো জীবনের শুকনো ডাল থেকে রস নিংড়িয়ে নিচ্ছে। আর এই ইচ্ছেমতো বেঁচে থাকার আকাক্ষাটাই তো এ সমাজের বড় দায়।
কাঠের গেটে মৃদু শব্দ করে সাব্বির ঢোকে। সাদা টেট্রনের প্যান্ট-শার্টে ভীষণ সুন্দর দেখাচ্ছে। সাব্বির নাসিমার বন্ধু। সালমার সঙ্গে আলাপ আছে। সাব্বিরকে দেখে উঠে দাঁড়ায় সালমা।
কেমন আছেন সাব্বির ভাই? ভালো। তুমি? ভালো।
চাবির রিং ঘোরাতে ঘোরাতে বাম দিকের সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে যায়। দুটো সিঁড়ি একসঙ্গে লাফিয়ে লাফিয়ে ওঠে। সালমার মনে হয় বিলেতি খরগোশের মতো। নিজে নিজেই ফিক করে হেসে ফেলে। আবার ধপ করে সিঁড়ির ওপর বসে পড়ে। মনে মনে ভাবতে চেষ্টা করে যে, সাব্বির এখন কী করছে? তালা খুলে ঘরে ঢুকেছে। দরজাটা ভেজিয়ে দিয়েছে। ফ্রিজ খুলে এক টুকরা কেক মুখে দিয়েছে। বোতলের মুখেই পানি খাচ্ছে। সাব্বির ভাইয়ের এই এক অভ্যেস। নাসিমা আপা মাঝে মাঝে রাগ করে।
তোমাকে কিছুই শেখানো গেল না সাব্বির।
আমি এমন বনমানুষই থাকতে চাই নাসিমা। বেশি সভ্য হয়ে লাভ কী? সভ্যতার ওই মেকিটুকু যত গায়ে জড়াবে তত ঠুনকো হয়ে যাব। কী বলো সালমা?
সালমা হাসে। সাব্বির সালমার দিকে ফিরে হাত নেড়ে বলে, দেখো সালমা, তুমি কিন্তু তোমার বন্ধুকে কখনো এমন করে শাসন করবে না কেমন? মাঝে মাঝে দুজনে একদম পেঁয়ো মূখের মতো আচরণ করবে। মনে করবে তোমরা সভ্যজগতের বাইরে বসবাস করছ। নইলে জীবনে কোনো চার্ম থাকে না সালমা। নাসিমাকে আমি কিছুতেই এ কথাটা। বোঝাতে পারি না।
সালমা কিছু বলার আগেই শুরু হয়ে যায় দুজনের তর্কবিতর্ক। ও তখন নিঃশব্দে কেটে পড়ে। তবু ওরা বেশ আছে। সালমা ভাবল, সাব্বির ভাই এখন বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে আছে। অথবা বড় সোফাটার ওপর চিত হয়ে পা দোলাচ্ছে। মুখে দেদার শিস বাজাচ্ছে। খুব আস্তে করে চেঞ্জার বাজছে।
দৃশ্যগুলো কল্পনা করতে সালমার বেশ লাগছিল। মাঝে মাঝে এমনি করে দৃশ্য সাজাতে ভালো লাগে। রঙের পরে রং। ছবির পরে ছবি। চোখ বুজে একের পর এক পৃষ্ঠা উল্টে যাওয়া। ভীষণ দুর্দান্ত ব্যাপার। দুর্দান্ত শব্দটা আসলে সালমার খুব প্রিয়। সামান্য কিছুকেই দুর্দান্ত ভাবতে ভালোবাসে ও। সাকিব মাঝে মাঝে বলে, তোমার শব্দ ব্যবহার ঠিক হচ্ছে না দিদিভাই।
কখনো ওই না-হওয়াতেই তো যত আনন্দ, যত রোমান্স। তুই কী বুঝবি হাঁদা কোথাকার।
শেষেরটুকু আবার বেশি বললি কিন্তু।
সাকিব এসে পেছন থেকে চুল ধরে টান দেয়।
তখন থেকে দেখছি বারান্দার ওপর বসে রয়েছিস?
তোর তাতে কী?
ইউনিভার্সিটি যাবি না?
না।
আমি চললাম।
সাকিব বেরিয়ে যায়। পরনে জিন্সের প্যান্ট। পায়ে কেডস। গায়ে বিদেশি গেঞ্জি। ব্যাডমিন্টনের চঞ্চল কর্কের মতো দেখাচ্ছে ওকে। সালমা হেসে ফেলল। এক একজনকে কেন্দ্র করে বেশ এক একটা উপমা মনে আসছে ওর।
সারা বাড়ি চুপচাপ। কেবল রান্নাঘর থেকে ছ্যাঁকছুঁক শব্দ আসছে। আনুর মা রাঁধছে। জলিল মিয়া বাগান ছেড়ে এখন ঘরদোর পরিষ্কার করছে। খাটতে পারে লোকটা। কাজের কথা বলতে হয় না। যতক্ষণ সময় পায় ততক্ষণ কিছু না কিছু করতেই থাকে। সালমা হাঁটতে হাঁটতে পেছনের বাগানে আসে। পেছন দিকটা একটু স্যাঁতসেঁতে। রোদ কম। তাছাড়া গাছগাছালির ঘন মাথার জন্য ভিজে ভিজে থাকে। সালমার খুব ভালো লাগে। নাসিমা মাঝে মাঝে বিকেলবেলা এখানে এসে বই পড়ে। এছাড়া আর কেউ আসে না। সালমার মনে হয়, এটা একলা ওর রাজত্ব। বড় কাঠের বাক্সে দুটো ধবধবে সাদা খরগোশ আছে। এ দুটো সালমার খুব প্রিয়। যত্ন করে পালে। নির্জন অবসরে ছেড়ে দেয়। কোলে নিয়ে ঘাস খাওয়ায়। চুপচাপ বসে ওদের ছুটোছুটি দেখে। আর তখনই মনে হয় এই সেই দ্বীপ। যে দ্বীপে ও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে ছিটকে পড়েছে। চারদিকে নীরব প্রকৃতি। আর কেউ ওকে সঙ্গ দেয় না। খরগোশ দুটো আনন্দ আর বেদনার মতো সালমার মনের মাঠে ছুটোছুটি করে। এর বাইরে আর কিছুই নেই। খরগোশ দুটোর নাম রেখেছে সুখ-দুঃখ। সালমার নির্জন পৃথিবীতে সুখ-দুঃখই একমাত্র সঙ্গী। এর বাইরে আর সব মিথ্যে। বাবা, মা, সাকিব, নাসিমা আপা, জলিল মিয়া সব মিথ্যে। ওদের উপস্থিতি সালমাকে তেমন নাড়া দেয় না। ওর না থাকলেও সালমার জীবন চলে। এই গাছগাছালির মতো নীরব অনুভূতি, দূরের আকাশের মতো এক টুকরো হৃদয়, মাটির মতো রক্তের উত্তেজনা, ওই খরগোশের ছুটোছুটির মতো আনন্দ আর বেদনা। এর বাইরে একটা মানুষের জীবনে আর কী থাকতে পারে? আর কিছু থাকারই বা প্রয়োজন কী? আর কী লাগে? আরো কিছু লাগে।