সালমা বিছানার ওপর বসে থাকে। গোলাপের গন্ধ ওকে আচ্ছন্ন করে। মোমবাতির শিখা কাপে। মৃদু নীল আলো রোমাঞ্চিত করে ওকে। রকিব ঘরে পায়চারি করে। সারাদিনের সমস্ত ব্যাপারটায় কোনো কিছু ভেবে দেখার অবকাশ ছিল না। উত্তেজনায় অনেকবার ওর হাত-পা কেঁপেছে। এখন সালমা ওর বউ। আজীবনের সঙ্গী। বউ শব্দটা রকিবকে আবার উত্তেজিত করে। ও সালমার পাশে এসে বসে।
সালমা।
বলো।
আমরা এখন কী করব?
তুমি বলো?
আমরা সারারাত জেগে জেগে কথা বলব।
তোমার ক্লান্তি লাগবে না?
একটুও না। আজ তো ক্লান্ত হবার দিন নয়।
তাই।
সালমা হাসে।
কথা বলতে বলতে একসময় কথা বন্ধ হয়। রকিব ঘুমিয়ে পড়ে। অনেক রাত পর্যন্ত সালমার ঘুম আসে না। গোলাপের গন্ধ এখনো তীব্র। মোমবাতি জ্বলে জ্বলে নিঃশেষ। সালমা উঠে জানালার ধারে এসে দাঁড়ায়। বারান্দায় বেরিয়ে এ-মাথা ও-মাথা পায়চারি করে। কখনো ঝুঁকে ঘুমন্ত রকিবের মুখটা ভালো করে দেখে। সারাদিনের উত্তেজনার পর ও এখন শান্ত।
আমি জানি না, তোমার ভালোবাসা আমাকে ধরে রাখতে পারবে কি না রকিব। বাঁধন আমার ভালো লাগে না। আমি হাঁপিয়ে উঠি। তুমি তো জানো, সোজা পথের বদলে চড়াই-উতরাই পথেই আমার সুখ বেশি। আজকের রাতের মতো এমন সুখের ক্ষণ আমার জীবনে বেশি নেই। ওই টুকরো টুকরো ক্ষণগুলো আমার বেহিসারি জীবনের ওপর মিঠে বাতাস বইয়ে দেয়। একটুক্ষণের জন্য শান্তি পাই। আবার যখন পথে নামব, আজকের রাতটা আমি সুগন্ধি পদ্মের মতো আমার হৃদয়ের জলে চিরকালের করে ভিজিয়ে রাখব রকিব। তুমি তার জন্য দুঃখ করো না।
ঘরে ফিরে ও আবার জানালার কাছে এসে দাঁড়ায়। মগজে অস্থিরতা দপদপ করছে। জানালার শিকে কপাল ঠেকায়।
আমি জানি, তুমি এখনো ঘুমোওনি বাবা। ঘুম তোমার আসছে না। তিনটের সময়ে ইউনিভার্সিটি গিয়ে অনেকক্ষণ বসেছিলে। বারবার ঘড়ি দেখছিলে। পাইপ টানছিলে। তোমার সামনে দিয়ে সব ছেলেমেয়ে চলে যাচ্ছিল। আর তুমি অস্থির হচ্ছিলে। একসময় হয়তো নিজে গাড়ি থেকে নেমে ইউনিভার্সিটির চত্বরে আমাকে খুঁজে বেড়িয়েছিলে। পাওনি। তুমি যাকে চোখে চোখে রেখেছিলে, যাকে নিতে এসেছিলে, দেখলে সে নেই। এরকমই হয় বাবা। কিন্তু তুমি তা কোনোদিনও বুঝতে চাওনি। ভাবতে যা তোমার চাই তা তোমার হাতের মুঠোয় পেতে হবে। এটাই যদি সত্য হতো বাবা, তাহলে সোনার হরিণ শব্দটি কেন?
এখন বেশ বুঝতে পারছি আমাকে ভালোবাসার বদলে নিজের আমিত্বকে প্রতিষ্ঠিত রাখাই ছিল তোমার লক্ষ্য। কোথায় সেই ভালোবাসা, যে ভালোবাসা আমার সমগ্র জীবনের ওপর ছায়া দিয়ে পাখা মেলে রাখবে? ভালোবাসাই যদি থাকবে তবে আমার জীবনের এত বড় একটা সিদ্ধান্তের ব্যাপারে তোমার ভূমিকা জল্লাদের মতো কেন? কেন ক্ষমতার দাপট আর দম্ভ তোমার আচরণের বড় হাতিয়ার? এতকাল শুধু সবার কাছে নতজান ভক্তি পেয়েছ বলেই আমার আচরণ ছিল তোমার অসহ্য। নিজের মেয়েকে ভালোবাসার বদলে চেয়েছ সেই নতজানু ভক্তি আর দীণ শ্রদ্ধা। সেটা পাওনি বলে তুমি ক্ষিপ্ত হয়েছিলে। তোমার বিবেকহীন চেতনায় তা ঘা দিয়েছিল। আর তাই তুমি তোমার ভালোবাসাকে আর প্রসারিত করতে পারলে না। ভালোবাসার রাশ টেনে ধরলে। যদি তুমি তা পারতে তাহলে বুঝতাম তুমি জাহিদ চৌধুরী অন্তত একটি জায়গায় নিজের মহত্ত্বকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছ। পারলে না। দুঃখ আমার নেই। জানতাম তুমি পারবে না। তোমার মানসিকতার প্রতিটি ছিদ্র আমার চেনা, তোমার প্রতিটি নিঃশ্বাসে আমি গন্ধ পাই। আমি বুঝি তুমি কী চাও। আমি জানি কতটুকু বললে তুমি নিঃশেষ হয়ে যাবে। আমি জানি কতটুকু ভাবলে তোমার সামনে দেয়াল এসে দাঁড়াবে।
আমাকে তুমি জন্ম দিয়েছ বাবা। সে জন্মের শোধ তুলতে চেয়েছিলে তোমার প্রভুত্বের যাঁতাকলে আমাকে পিষ্ট করে। কিন্তু তুমি কি জানেনা বাবা, যারা দাস হয়ে জন্মায় তারা কোনোদিন প্রভু হতে পারে না? তুমি ওই মূলটা ধরতে পারনি। প্রভু হবার আজীবন সাধনা করে তুমি চিরকাল দাস মনোভাব নিয়ে কাটিয়ে দিলে। যারা চেতনার অন্ধিসন্ধির প্রতিটি ফোকর গলিয়ে ঢুকে ভেতরের চেনাপথ খুঁজে পায় না তারা তোমার মতো বিভ্রান্তি নিয়েই সারাজীবন কাটায়। সেজন্য তুমি মোটেও অনুতপ্ত নও। কেননা ব্যবহারিক চাকচিক্যে তোমার আগ্রহ অনেক বেশি। অবশ্য তুমি পেয়েছেও অনেক। কার্পেট মোড়ানো সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠেছ। আর ওইখানেই আমার যত ঘৃণা।
আমি চেয়েছিলাম একজন শক্তিমান পিতা, একজন মহৎ পিতা। আমি… চেয়েছিলাম… একজন শক্তিমান… বাবা … যার ছায়ায় দাঁড়িয়ে আমি নিজের অস্তিত্বকে মহান বলে অনুভব করতে পারতাম। যার আত্মঅহংকার আমার মানস চেতনায় চিরকালের প্রদীপ হয়ে জ্বলত। তুমি তা হতে পারনি। তাই তুমি আমার ওপর তোমার অধিকার টিকিয়ে রাখবে কিসের জোরে? ভালোবাসা নয়, তোমার ঘৃণা নিয়ে আমি দূরে সরে যেতে চাই। আমি যা করেছি, তার জন্য আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাই না। কেননা আমাকে তুমি ক্ষমা করতে পার না। তোমার ব্যর্থতাকে আমি নিজে অতিক্রম করব বলে পথে নেমেছি। তোমার কাছে কোনোদিন পৌঁছবে না আমার সে পদশব্দ।