সাকিব কুশিতে ডগমগ হয়ে বেরিয়ে যায়। সালমা বইয়ের পাতায় মনোযোগ দেয়। কিন্তু বেশিক্ষণ পড়তে পারে না। সব মুছে গিয়ে বইয়ের পাতার ওপর কেবল দক্ষিণ সাগরের একটি দ্বীপের ছবি ভেসে ওঠে। সাগর দিয়ে ঘেরা, নারকেলবীথির ছায়া দিয়ে ভরা একটি মনোরম দ্বীপ।
সোমবার সকাল থেকে সালমা এক লাইনও আর পড়তে পারে না। বুকটা কেমন যেন করে। বাথরুমে অনেকক্ষণ কাটিয়ে দেয়। অনবরত গায়ে মাথায় পানি ঢেলেও তৃপ্তি হয় না। ভিজে ভিজে ঠোঁট দুটো সাদা হয়ে ওঠে। মা এসে বকা দেয়। তোয়ালে দিয়ে চুলের গোছা পঁাচাতে পাচাতে বেরিয়ে আসে। ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়ায়। আনুর মা হরলিকস দিয়ে যায়। সালমা খেতে পারে না। কেমন তেতো লাগে। বুকটা ধড়ফড় করে। নসিয়ার মতো লাগছে। আলমারি ঘেঁটে যা টাকা পায় সব কটি টাকা পার্সে ভরে নেয়। শাড়ি পরতে না পরতে সাকিব এসে হাজির হয়।
দিদিভাই তোর হয়নি? বাবা দাঁড়িয়ে রয়েছে তোর জন্য।
কেন?
বাবা তোকে ইউনিভার্সিটি পৌঁছে দেবে।
আজকে হঠাৎ।
জানি না।
সালমা থমকে যায়। আজ পরীক্ষা শেষ। বাবা হঠাৎ এমন উৎসাহী হয়ে উঠল কেন? সালমা তো বরাবর রিকশা করে ইউনিভার্সিটি যায়। একবার ভাবল যাবে না বাবার সঙ্গে। আবার ভাবল না থাক। অহেতুক কোনো ঝামেলার মধ্যে না যাওয়াই ভালো। সুবোধ মেয়ের মতো সালমা বাবার সাদা ড্যাটসানে গিয়ে ওঠে। গাড়িটা গেট পেরিয়ে যাবার সময় সালমা পেছনে ফিরে দেখে মা আর সাকিব বারান্দায় দাঁড়িয়ে। ও ফিরে তাকাতে মা হাসল। সাকিব হাত নাড়ল। সালমাও হেসে হাত নাড়ল। তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে সোজা সামনের দিকে তাকিয়ে রইল। বাবা কথা বলছে না। মুখে পাইপ। সালমা ইউনিভার্সিটিতে নেমে যাবার সময়ে বাবা বলল, তিনটের সময় আমি তোমাকে আবার নিতে আসব। তুমি ওই সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে থেক।
আচ্ছা।
সালমা আর কথা না বলে চলে যায়। ওর মনে হচ্ছে, ওর অন্তরে আর কোনো রাগ নেই। কোনো ক্ষোভ, কোনো বিদ্বেষ নেই। ও সবকিছু ভীষণ স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতে পারছে। সকলের দিকে ভালোবাসার দৃষ্টি নিয়ে তাকাতে পারছে এবং নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা অর্জন করেছে। হলে ঢোকার আগে রকিব একবার কাছে এসে নিচু গলায় বলল, তোকে অপূর্ব দেখাচ্ছে সালমা।
তাই নাকি?
হ্যাঁ। মনে হচ্ছে তোর চেহারাটা যেন পাল্টে গেছে।
চেহারা নয়, পাল্টেছে মন। যাকগে, শোন রকিব, আজ যে করে হোক ঠিক দশ মিনিট আগে পরীক্ষার হল থেকে বেরোতে হবে।
বলিস কী? কী ব্যাপার?
ভীষণ জরুরি। তোকে পরে সব বলল। পারবি না বেরোতে?
তোর জন্য কি না পারি?
সুযোগ পেলে বাহাদুরি নিতে ছাড়িস না।
দুজনেই হাসতে হাসতে হলে ঢুকে যায়।
তিনটে বাজার দশ মিনিট আগে সালমার মুখের দিকে হা করে তাকিয়ে থাকে রকিব। ঘাড়-বাঁকানো তেজি ঘোড়ার মতো দেখাচ্ছে ওকে। এখুনি বুঝি দিগ্বিদিক ছুটবে। সকালের সেই দীপ্র সৌন্দর্যের কমনীয়তা এখনো মুখজুড়ে। কোথাও কোনো পরিবর্তন নেই। অথচ আশ্চর্য তার বিকাশ। একই সঙ্গে আগুনের লাল এবং নীল শিখার মতো। একদিকে সৌন্দর্য, অন্যদিকে তেজ।
কী, অমন করে চেয়ে রয়েছিস কেন?
আমি বিশ্বাস করতে পারছি না সালমা।
বেশি কথা বলার সময় আমাদের নেই।
তুই ভালো করে ভেবেছিস তো সালমা।
সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করি না রকিব।
উঃ, সালমা কী যে খুশি লাগছে! আমি এক্ষুনি রাজি।
রকিব ওর হাতে চাপ দেয়। দুজনে সিঁড়ি দিয়ে দ্রুত নামতে থাকে।
কিন্তু?
রকিব থমকে দাঁড়াল।
কিসের কিন্তু?
উঠব কোথায়?
এই ঠিকানায়।
সালমা একটা ছোট্ট কাগজ রকিবের সামনে মেলে ধরে। উত্তেজনায় রকিবের হাত কাঁপে। সালমা হাসে। সহজ হাসি। রকিবের মনে হয় এই মুহূর্তে সালমা ওর বুকের সঙ্গে মিশে আছে। সেখান থেকে বিচ্ছিন্ন করা আর কারো পক্ষে সম্ভব নয়।
বিকেলের মধ্যে সব ঘটনা নির্বিবাদে ঘটে যায়। রকিবের কাছে তা স্বপ্নের মতো মনে হয়। সব কাজ শেষ করে ওরা যখন বনানীতে নাসিমা আর সাব্বিরের বাসায় পৌঁছে তখন শেষ বিকেল। লালচে হলুদ আলো ছড়ানো সবখানে। রিকশা থেকে নামার সময় রকিব ওর দিকে তাকিয়ে বলছিল, এখন কেমন লাগছে সালমা?
আকাশে ওড়া পাখির মতো। একদিকে মুক্তির আনন্দ, অন্যদিকে ভালোবাসার স্বাদ।
বাব্বা কত যে ভাবনা।
দুজনে হাসতে হাসতে এসে দরজায় করাঘাত করে। সে শব্দ সালমার বুকে ঘণ্টাধ্বনির মতো বাজে।
সাব্বির ওদের দেখে চেঁচিয়ে ওঠে।
আরে সালমা যে? কতদিন পর এলে।
এতদিন পর আমাদের মনে পড়ল তোর। আমি ভাবলাম তুই বুঝি ভুলেই গেছিস।
তোমাকে কী ভুলতে পারি? সালমা ব্রিত মুখে জবাব দেয়।
কী ব্যাপার, তোমাকে অমন জড়সড় দেখাচ্ছে কেন সালমা? দেখো নাসিমা, সালমাকে আজ কেমন একটু অন্যরকম লাগছে।
হ্যাঁ, আমিও তাই দেখছি।
নাসিমা’পা আমি বিয়ে করেছি।
কী বললে? তাই বল। সাব্বির চেঁচিয়ে ওঠে।
বিকেলে বিয়ে হয়েছে। আজ রাতে তোমাদের এখানে থাকব।
তার মানে বাসর? নাসিমা তুমি আয়োজন করো। আমাদের কী ভাগ্য!
উহ চমৎকার! কী খুশির খবর!
নাসিমা সালমাকে জড়িয়ে ধরে। টানতে টানতে শোবার ঘরে নিয়ে যায়। ব্ৰিত রকিব খুব একটা কথা বলতে পারে না। কেবল সাব্বিরের অনেকগুলো প্রশ্নের জবাব দেয়।
তারপর নাসিমা আর সাব্বির দুজনে মিলে ওদের জন্য অনেক আয়োজন করে। নতুন শাড়ি কিনে আনে। নতুন প্রসাধনী দিয়ে ওকে। সাজিয়ে দেয়। বিছানায় গোলাপ ছড়িয়ে বাসর তৈরি করে। সালমার ইচ্ছে অনুযায়ী ঘরে লাইটের বদলে মোমবাতি জ্বালায়। বেশি রাত না করে তাড়াতাড়ি খাইয়ে দাইয়ে দুজনকে ঘরে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দিয়ে যায়। ওরা।