আজ থাক।
কেন?
ভালো লাগছে না।
সালমা?
আমার ভেতরে ভীষণ একটা অস্থিরতা। তোকে আমি তো বোঝাতে পারব না রকিব। খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসার আগে সব প্রাণীর মধ্যে বোধহয় এমন রিনরিনে যন্ত্রণার কাঁপুনি থাকে। আমি এখন সেই ভয়ানক সময়ের শিশিরে গা ড়ুবিয়েছি।
সালমা চল তোকে পৌঁছে দিয়ে আসি।
না থাক, আমি একলাই যেতে পারব। এখনো আমার সময় হয়নি রকিব।
সালমা হাঁটতে আরম্ভ করে। রকিবও ওর পাশে পাশে হাঁটে। সালমার পিঠে লম্বা বিনুনি দোলে। ছাপা শাড়িতে ওকে আজ জংলি মেয়ের মতো দেখাচ্ছে। চুলগুলো বারে বারে কপালে এসে পড়ে। রকিবের লোভ হয়। ইচ্ছে করে বুকে টেনে নিয়ে চুমু খেতে, ঠোঁট ঘষে ঘষে ওই কপাল থেকে চুলের গুচ্ছ সরিয়ে দিতে, লম্বা নখ সংবলিত সরু আঙুলগুলো নিজের মুঠিতে ধরে রাখতে। কিন্তু হয় না। আশপাশ দিয়ে ছেলেমেয়েরা যাওয়াআসা করছে। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় একটু ক্লান্ত দেখায় সালমাকে। একটু অন্যমনস্কও। ও গভীরভাবে কিছু ভাৰছে। রকিব ভাবল। একটা রিকশা ডেকে তুলে দেওয়ার পরও সালমা বেশি কথা বলল না। কেবল বলল, আসি।
রকিব ভেবেছিল সালমা আরো কিছু বলবে। আরো একটু অন্তরঙ্গ হবে রকিবের সঙ্গে। কীভাবে সমস্যার সমাধান করবে সে সম্পর্কেও। জিজ্ঞেস করবে। কিন্তু সালমা কিছু বলল না। শুধু একরাশ ক্লান্তি ফেলে রেখে গেল রকিবের জন্য। ওর ক্লান্ত মুখটা বারবার ভেসে ওঠে রকিবের সামনে।
রিকশা থেকে নামতেই সালমা দেখল বাবা সিঁড়ির ওপর দাঁড়িয়ে। মিস্ত্রিদের কাজের তদারক করছে। জলিল মিয়া ফুলের বেড পরিষ্কার করছে। সালমা খুব সন্তর্পণে কাঠের গেটটা খুল। এ বাড়ির প্রতিটি জিনিসের ওপর ওর খুব মায়া হচ্ছে। গেটটায় তবু ক্যাচ করে একটা শব্দ হলো। জলিল মিয়া ওর দিকে তাকিয়ে হাসল। সালমা সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময়ে বাবা জিজ্ঞেস করলেন, পরীক্ষা কেমন হলো?
ভালো।
সালমা পাশ কাটিয়ে ঘরে উঠে গেল। এর বেশি কোনো কথা কেউ বলল না। অন্যদিন হলে বাবা খুঁটিনাটি অনেক কথা জিজ্ঞেস করতেন। সালমা বইখাতা টেবিলে ছুড়ে মেরে বাথরুমে ঢুকল। মুখ-হাত ধুয়ে চুপচাপ শুয়ে থাকল অনেকক্ষণ। মাথা ধরেছে। নসিয়ার মতো লাগছে।
আনুর মা চা দিয়ে গেল। হয়তো আনুর মার কাছে শুনে মা এলো।
কীরে শরীর খারাপ নাকি?
মাথা ধরেছে।
মাথার আর দোষ কি। চার ঘণ্টা একনাগাড়ে পরীক্ষা দেওয়া কি কম কথা? একটা নোভালাজিন খেয়ে নে।
পাঠিয়ে দাও।
একটু পরে মা নিজেই এলো নোভালজিন নিয়ে। সযত্নে খাইয়েও দিলো। মাথার কাছে বসে কপালে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। সালমা বুঝে পেল না হঠাৎ এত আদর কেন? ওর খুব খারাপ লাগল। এই মুহূর্তে কেউ না থাকলেই ভালো। এক একটা সময় আসে কেউ না থাকলে খারাপ লাগে–এক এক সময় কেউ থাকলে। সালমা চাইল মা চলে যাক। কিন্তু মুখে কিছু বলতে পারল না। ভাবল আর কটা দিনই বা। ও ইচ্ছে করেই পাশ ফিরে শুলো। ঘুমের ভান করল। মা আস্তে উঠে গেল। যাবার সময় দরজা বন্ধ করে দিল। সালমা ভাবল সোমবার পরীক্ষা, আজ বৃহস্পতিবার। মাঝে আর কটা দিন। অসংখ্য চিন্তা এলো মনে। কয়েক হাজার মতো তা গেঁথে গেল মনে। স্মৃতিটা বড় কষ্টদায়ক। সালমা বিছানা ছেড়ে জানালার পাশে এসে দাঁড়ালু আবারো ভাবল, স্মৃতিটা বড় কষ্টদায়ক। একবার বাবা ওকে একজোড়া লাল জুতো কিনে দিয়েছিল। ঘুরেফিরে সে জুতো জোড়ার কথা মনে পড়তে লাগল ওর। স্মৃতিটা কখনো লাল।
আস্তে দরজা ঠেলে জলিল মিয়া ঢুকল। হাতে এক তোড়া ফুল। দুই গাছি বকুলের মালাও।
আপামণি।
কী ব্যাপার জলিল ভাই?
তোমার জন্য ফুল এনেছি।
সালমা হাত বাড়িয়ে ফুল নিল। জলিল মিয়া ওকে আর কখনো ফুল দিয়েছে কি না তা মনে পড়ল না সালমার। ও ধরে নিয়েছে সালমার বিদায়লগ্ন আসন্ন। সে জন্য ফুল দিতে এসেছে।
আপামণি।
বলো।
এবার তো সত্যি তুমি আমাদের ছেড়ে যাচ্ছ আপামণি।
জলিল মিয়া গামছা দিয়ে চোখ মোছে। গলাটা কেশে পরিষ্কার করে। সালমার নিরুত্তর মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, সাকিব ভাই বলেছিল বাসরঘর সাজানোর জন্য অনেক ফুল দরকার, তোমার কী কী ফুল পছন্দ বলো?
আমার সব ফুল পছন্দ জলিল ভাই।
তবু কোনটা বেশি ভালো লাগে?
গোলাপ। লাল গোলাপ।
আচ্ছা।
জলিল মিয়া হেসে মাথা নাড়িয়ে চলে গেল। ও খুব খুশি হয়েছে। ওই গেঁয়ো লোকটাকে কষ্ট দিতে চায় নি ও। সালমার একটা মুখের কথায় ও যদি ক্ষণিকের আনন্দ পায় তাহলে দোষ কী? বকুলের মালা দুটো ও হাতে জড়িয়ে রাখল। তোড়াটা নাকের কাছে উঠিয়ে গন্ধ শুকল। গন্ধে বুকটা ভরে যায়। পবিত্র মনে হয় নিজেকে। জীবনের কতগুলো সময় এমনি পবিত্র। কেউ তাকে কলুষিত করতে পারে না।
রোববার সারাদিন সালমা নিজের ঘরে কাটাল। কেউ ওকে বিরক্ত করল না। আনুর মা কয়েকবার এসে এটা-ওটা দিয়ে গেল। মনে মনে বলেছিল, সব শাড়ি তুমি নিয়ে যাও আনুর মা। ওতে আমার আর দরকার নেই। কিন্তু বলতে পারেনি। আনুর মার ওপর মায়া হয়েছিল। বেচারি বিশ্বাস করতে পারবে না। মনে মনে কষ্ট পাবে। কষ্ট কাউকে ও আর দিতে চায় না।
রাতে সাকিব আসে গয়নার বাক্স হাতে নিয়ে।
দেখ তো দিদিভাই কেমন হয়েছে?
খু-উ-ব সুন্দর!
তোর পছন্দ হয়েছে?
হ্যাঁ।
যাক, বাঁচলাম।
ডিজাইন কে পছন্দ করেছে রে?
বড় খালা আর মা। আমিও সঙ্গে ছিলাম।
তুই সঙ্গে থাকলে কোনো জিনিস কি খারাপ হবার উপায় আছে?
থাক, বেশি পাম্প দিতে হবে না।