সালমা বাঁকা করে তাকাল, এত আয়োজন কেন রে? তোর সঙ্গে মিতালির বিয়েটা তাহলে হয়েই যাচ্ছে?
যা, কী যে বলিস? আমি তো তোর ছোট।
সালমা থমকে গেল। সাকিব বেশ কৌশলে উত্তর দিতে শিখেছে তো। সেই আশ্চর্য ছেলেমানুষিসুলভ কমনীয়তা বিন্দুমাত্র নেই। বড় বড় গোঁফ রেখেছে আবার। গায়ে ভারী হয়েছে বেশ। ও এখন আপন অন্তরে বলিষ্ঠ পৌরুষত্ব লালন করছে। সাকিব নিজেকে অতিক্রম করতে চলেছে। লক্ষণটা মন্দ না। ভালো। সালমার খুশিই লাগল।
গোলাপি রংটা বেশ সুন্দর, ওটাই দিয়ে দিই। কী বলিস দিদিভাই?
কেন সাদা কী দোষ করল?
সাদা? সাকিব আমতা আমতা করে।
খারাপ কী?
যৌবনের রং চাই দিদিভাই। ওইসব সাদাটাদা দিয়ে পোষাবে না। তাছাড়া উৎসব মানেই রঙের সংমিশ্রণ; সে বাহ্যিক এবং মানসিক দুটোই।
সালমা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে।
চোখ বড় বড় হয়ে ওঠে। বিশ্বাস হতে চায় না যে সাকিব এত কথা বলছে।
তাহলে ওই গোলাপিটাই থাক দিদিভাই?
তোর যা খুশি।
সাকিব চলে গেলে সালমার বুকটা ভার হয়ে আসে। ওকে না জানিয়ে ওর সম্পর্কে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে জাহিদ চৌধুরী। তারই তোড়জোড় চলছে বাড়িজুড়ে। ঘনঘন খালারা আসছে। মামা, ফুফু আসছে। কেনাকাটা হচ্ছে। বাবা গম্ভীর। সালমার সঙ্গে হেসেও কথা বলে না। যেন ওর সম্পর্কে যা ভাবা হয়েছে তাই চূড়ান্ত। এ নিয়ে সালমার নিজস্ব কোনো বক্তব্য থাকতে পারে না অথবা কোনোকিছুই ভাবার অধিকারও ওর নেই। সালমা একদিন পাশের ঘর থেকে বড় মামা আর বাবার কথাবার্তা শুনেছিল। বড় মামা বলেছিলেন, এ বিয়েতে সালমা মত দিয়েছে তো?
ওর আবার মতামত কী? আমরা যা করব তাই মেনে নিতে হবে।
কাজটা কি ভালো হচ্ছে?
খারাপটা কী হলো শুনি? আদর দিয়ে দিয়ে ওকে আমি অনেক নষ্ট করেছি। ও আমার কোনো মর্যাদা রাখেনি। কোনো সুযোগ ওকে আর দেওয়া হবে না।
বাবার কথাগুলো জল্লাদের নিষ্ঠুর কণ্ঠস্বরের মতো ভেসে আসছিল। বড় মামা হয়তো চুপ করে গিয়েছিলেন। কেননা আর কোনো কথা ও শুনতে পায়নি। অবশ্য বাবার কথায় সালমার বুক কাঁপেনি। অত দুর্বল স্নায়ু ওর নয়। তবে বাবা নিপুণ কৌশলী। ভূমিকা বদলেছে সযত্নে। সব দেখেশুনে সালমা নীরবতা অবলম্বন করেছে। ফুফুদের, মামাদের সঙ্গে হেসে হেসেই কথা বলে। যেন এ বাড়িতে এমন কিছু হচ্ছে, যার বিন্দুবিসর্গ ও জানে না। পরীক্ষার পড়া ছাড়া ও কিছু বোঝে না। সালমা সবার সঙ্গে আচরণে একটা ছোট্ট সরল বোকা মেয়ে হয়ে যায়। সাকিব মাঝে মাঝে অবাক হয়। সালমাকে ও চেনে। এ আচরণ ওর যথার্থ না ভান বুঝতে পারে না। দিদিভাই এত সহজে সবকিছু মেনে নিচ্ছে? পরক্ষণে ভাবে আসলে সব মেয়েই এক। বিয়ের কথা শুনলে খুশিই হয়। কখনো সালমাকে বলে, দিদিভাই তোকে আজকাল ছটফটে সি-খুশি দেখায়।
পরীক্ষাটা ভালো হচ্ছে তো!
পরীক্ষাটা ভালো, না অন্য কিছু?
সালমা একটুক্ষণ গালে হাত দিয়ে ভেবে বলে, না অন্য কিছু তো খুঁজে পাচ্ছি না।
পাচ্ছিস। পাচ্ছিস। আমাকে বলবি না।
সাকিবের মুখে চাপা হাসি ফুটে ওঠে। সালমা মনে মনে হাসে। তুমি ছেলে সেয়ানা হচ্ছে। আমার সঙ্গে টেক্কা লড়তে এসেছ। লড়ো। দেখি কে জেতে। সাকিব সালমার বেণি টেনে দিয়ে হাসতে হাসতে চলে যায়।
থার্ড পেপার পরীক্ষার পর হল থেকে বেরোতে রকিব এসে ওকে ডাকে। তোর সঙ্গে একটু কথা ছিল সালমা।
ওকে দেখে চমকে ওঠে সালমা। চোহরায় অদ্রিার ছাপ। চোখজোড়া লাল। চুলে তেল নেই। পাঞ্জাবির বোম খোলা। সালমা কথা না বলে ওর সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে করিডরের শেষ মাথায় আসে। একটা থামের গায়ে হেলান দিয়ে সালমা দাঁড়ায়। রকিবের রুক্ষ কণ্ঠ চড়চড় করে ওঠে। শব্দটা অনেকটা মড়মড় করে গাছ ভেঙে পড়ার মতো।
আমার সঙ্গে ছলনার কী দরকার ছিল সালমা?
ছলনা?
গতকাল নিউমার্কেটে সাকিবের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। ও সব বলল।
আমি কিছু জানি না।
বিয়ের তারিখ পর্যন্ত ঠিক হয়ে গেছে।
আমি জানি না।
কার্ড ছাপানো শেষ?
আমি জানি না।
কেনাকাটা সব শেষ?
আমি জানি না।
বিয়ের পর তুই কানাডা যাচ্ছিস?
আমি জানি না।
সালমা তুই এত নিষ্ঠুর কেন? আমার জন্য তোর কি এখনো কোনো সময় হয়নি?
অকস্মাৎ রকিবের কণ্ঠ খাদে নেমে যায়। সালমা শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কথা বলে না।
এত বড় একটা খবর তুই আমাকে গোপন করে গেলি সালমা! আর সাকিব আমাকে করুণা করল। ব্যঙ্গের হাসি হাসল। তোর ওপর আমি জোর করতে পারি। জোর করে একটা হেস্তনেস্ত করতে পারি। কিন্তু তাতে লাভ? ভালোবাসা তো জোরের ব্যাপার নয়। ভালোবাসা তো প্রভুভূত্যের সম্পর্ক নয়। ভালোবাসা পবিত্র সেখানে দুজনের অধিকার সমান। সেটা পারস্পরিক সমঝোতার ব্যাপার।
তুই থাম রকিব।
সালমা জোরে চেঁচিয়ে কথা বলে, রকিবও সমানভাবে উত্তর দেয়।
আমি তোর শেষ কথা জানতে চাই?
ফোর্থ পেপারটা হয়ে যাবার পর আমি তোকে আমার কথা জানাব।
সত্যি?
বিশ্বাস করতে পারছিস আমাকে?
ওই বিশ্বাস না থাকলে তো আমার ভালোবাসা মিথ্যে।
মাথা ঠাণ্ডা করে পরীক্ষাটা শেষ কর রকিব।
সালমা মুরব্বির মতো কথা বলে। এতক্ষণ পর রকিব হঠাৎ হো হো করে হাসে। সালমা হাসতে পারে না। সাদা দেয়ালে দৃষ্টি ফেলে রাখে। রকিব হাসছে। বেশ প্রাণখোলা হাসি। ওর কষ্টের দ্বীপে ওই হাসি নিঝুম বনের কেওড়া পাখি। বিষণ্ণতা কাটিয়ে দিয়ে যায়। পাখা মেলে দিলে চকচকে ডানায় সূর্যের আলো ভরে ওঠে।
চল ওই মাঠে গিয়ে বসি সালমা?