মাথার ওপর দিয়ে একটা প্লেন উড়ে যায়। সালমা মুখটা ঘোরায়। প্লেনের শব্দ দূরে মিলিয়ে যাবার পর বলে, তোর প্রিপারেশন কেমন হয়েছে রকিব?
রকিব মুখ ঘোরায়। চোখের দৃষ্টিতে মেদুর ছায়া। নির্জন দ্বীপের সাগর-ঢেউ আটকে আছে ওখানে। মাথা নাড়িয়ে বলে, ভালো।
আমার মনে হচ্ছে, আমিও খুব খারাপ করব না।
তা আমি জানি। মাস দুই পড়লে তুই ফার্স্ট ক্লাস পেতিস। এখন বোধহয় তা পারবি না।
সালমা হাসে। কথা বলে না। রকিব উঠে দাঁড়ায়।
যাবি?
হ্যাঁ, যাই। অনেকটা সময় নষ্ট করলাম।
নষ্ট? কী জানি অনেকটা সময় সঞ্চয় করলাম বোধহয়।
তাই নাকি? নতুন কথা শোনাচ্ছিস যে?
আমি কি কখনো তোকে পুরনো কথা শুনিয়েছি?
তা বটে। আসি সালমা।
রকিব লাইব্রেরিতে গিয়ে ঢোকে। সালমা সেমিনারের দিকে যায়।
পরীক্ষার দিন পনেরো আগে থেকে সালমা দরজা বন্ধ করে পড়াশোনা শুরু করেছে। কারো সঙ্গে খুব একটা দেখা সাক্ষাৎ হয় না। আনুর মা ঘরেই খাবার দিয়ে যায়। বাবাও ওঁর ডিসটার্ব হবে বলে খাবার টেবিলে ডাকে না। সাকিব মাঝেমধ্যে আসে। টুকটাক কথা বলে। চলে যায়। সালমা কেমন হাঁপিয়ে ওঠে। মনে হয় পারবে না। আবার বেয়াড়া মনটাকে বাগে আনে। শান্ত মেয়ের মতো পরীক্ষার পড়া শেখে। মাঝে মাঝে বিকেলে বাগানে নামে। অবশ্যই যেদিন টের পায় যে বাসায় কেউ নেই, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে জলিল মিয়ার কাজ দেখে। কামিনী ফুলের ওপর মৌমাছি দেখে। সুখ-দুঃখের বাক্সের কাছে গিয়ে বাচ্চাগুলোকে আদর করে। একদিন হঠাৎ করেই নাসিমার বাসায় গিয়ে ওঠে।
নাসিমা ওকে দেখে অবাক হয়।
কীরে এতদিন কোথায় ছিলি? শুকিয়ে গেছিস যে?
পরীক্ষার পড়া নিয়ে ব্যস্ত।
তুমি এসে ভালো করেছ সালমা। সাব্বির একমুখ ধোয়া ছেড়ে কথা বলে। মুখটা প্রফুল্ল।
কেন সাব্বির ভাই?
দেখছ না বাঁধাছাদা চলছে।
কী ব্যাপার নাসিমা’পা?
আমরা এ বাসা ছেড়ে চলে যাচ্ছি সালমা।
চলে যাচ্ছ? কোথায়?
বনানীতে।
কেন এ বাসা কী দোষ করল?
নাসিমা লাজুক হাসল।
ছোট দু’কামরায় কি আর হয় রে? এখন আমাদের একটা বড় বাসা দরকার।
ব-ড়-বা-সা-।
সালমা বিড়বিড় করল। তারপর হঠাৎ গভীর চোখে নাসিমার দিকে তাকাল। নাসিমাকে একটু রোগা রোগা দেখাচ্ছে। বাসি শিউলির বোটার মতো ফ্যাকাশে। প্রশ্নটা সালমার মনের মধ্যে আনাগোনা করে। ওর এখন আকাক্ষিত স্বপ্নের দিকে পানসি ভাসিয়েছে। সে পানসির গতিতে এখন অনুকূল হাওয়া। তরতর করে ছুটছে। তাই ওদের এখন বড় বাসা চাই। অনেক বড় বাসা। বড় বাসা না হলে ওদের কাক্ষিত ফসলের সংকুলান সম্ভব নয়।
কী ব্যাপার তুমি যেন চিন্তায় পড়েছ সালমা?
আপনারা চলে যাবেন ভাবতেই খারাপ লাগছে।
তাই তো তোমার আপাও খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করেছে। কিছুই খেতে পারছে না।
যাহ, কী যে ফাজিল তুমি!
নাসিমা গোপন কটাক্ষ ছুঁড়ে মারে। সালমা দেখেও না দেখার ভান করে। ব্যাপারটা ওর কাছে এখন পরিষ্কার।
কবে যাচ্ছেন আপনারা?
আগামীকাল।
ফোন বেজে ওঠে। সাব্বির ফোনে কথা বলে। নাসিমা একটু কাজ করে কেমন হাঁপিয়ে ওঠে। ডিভানের ওপর পা ছড়িয়ে বসে। সালমা চারদিকে তাকিয়ে দেখল। নাসিমার বাসায় আজ আর কোনো ফুল সাজানো নেই। ফ্লাওয়ার ভাসগুলো সযত্নে একটি ঝুড়িতে ভরা হয়েছে। সাব্বির ফোন ছেড়ে এসে আবার বই গোছাতে আরম্ভ করেছে। বইয়ের শেলফগুলো আজ খালি।
কী ব্যাপার তুমি যে একদম হাত-পা ছেড়ে দিয়েছ নাসিমা?
একটু জিরিয়ে নিই।
দেখ সালমা, শোনো কথা। ভাবখানা এই যেন মাঠে হাল চালাচ্ছে।
আপার শরীরটা একটু খারাপ মনে হচ্ছে?
তা আর হবে না—
দেখো ভালো হবে না বলছি।
নাসিমা উঠে দাঁড়ায়। সাব্বির হাসতে শুরু করে।
বসো বসো। উঠতে হবে না তোমার।
সালমার মনটা খারাপ হয়ে যায়। কোনো কাজ খুঁজে পায় না। কী করবে বুঝতে পারে না। এই পরিবেশে নিজেকে ভয়ানক অবাঞ্ছিত মনে হয়।
আমি যাই নাসিমা’পা।
কেন, যাবি কেন? বস না।
তুমি তো আচ্ছা মেয়ে সালমা, আমাদের ঠিকানা পর্যন্ত নিলে না?
দিন।
সাব্বির কাগজের ওপর ঠিকানা লিখে সালমাকে এগিয়ে দেয়।
নাও। যখন সময় পাবে তখুনি চলে আসবে।
তোকে মাঝে মাঝে আমাদের মধ্যে পেলে খুব খুশি হব সালমা।
দেখ পরে যেন বিরক্ত হয়ে যেও না।
পাগল। কী যে বলিস।
ঠিক? মনে থাকবে তো?
পরীক্ষা নিস।
আচ্ছা।
ওর সঙ্গে তুমি অত কথা বলো না তাসিমা। দেখো, সালমা হয়তো কোনোদিনই আমাদের ওদিকে যাবেনা।
কীরে ঠিক নাকি?
সালমা হাসে। কথা বলে না। অনেকক্ষণ গল্পসল্প করে বেরিয়ে আসে ও। দরজায় আজ লাল পর্দা নেই। ওরা সব খুলে নিয়েছে। সব বাধাছাদা করছে। ওরা একটা বাসায় যাচ্ছে। সালমা ভাবল ছোট বাসায় ওদের সুখ হয়তো আর আটকিয়ে রাখা যাচ্ছে না। তাই এখন বিস্তার চাই। দেয়ালভাঙা বিস্তার।
বারান্দায় সিঁড়ির ওপর বসে রইল ও। এখনো কেউ বাড়িতে ফেরেনি। কৃষ্ণচূড়ার মাথার ওপাশে সালমা সূর্য ডোবা দেখেনি। আকাশটা লাল হলো। লাল থেকে বেগুনি। তারপর কালচে। সব শেষে নিকষ কালো। জলিল মিয়া ঘরে ঘরে বাতি জ্বালিয়েছে। দূরে একঝক বাদুড় উড়ে যেতে দেখল সালমা। কাঁপা কাঁপা ডানার ফাঁকে টুকরো আকাশ সালমার মনের মধ্যে আঁধার হয়ে নামল। কলাবতী ঝোপ থেকে আর কোনো লাল ফুল মাথা দোলাল না। সালমা টেবিলের সামনে এসে বই খুলে বসল।
সালমার যেদিন পরীক্ষা শুরু হলো সেদিন এ বাড়িতে মিস্ত্রি এলো। গোটা বাড়ি রং করা হবে। দরজা-জানালা ঠিক করা হবে। সাকিব কায়দা করে জিজ্ঞাস করল, বল না দিদিভাই, কী রং করলে বাড়িটা সুন্দর দেখাবে?