আস্তে আস্তে সে সুর বুকের তলে লাফিয়ে পড়ে। যন্ত্রণা নামের শৌখিন অথচ মেজাজি বেহালা-বাদক হয়ে যায়। বুকটা খাখা করে। আবার সালমা তলিয়ে যেতে থাকে।
পরদিন লাইব্রেরির সামনে রকিবের সঙ্গে দেখা হয়। শুধু দেখা নয় দুজনেই মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যায়। সালমার বুকটা নেচে ওঠে। মনে মনে ও বুঝি রকিবকেই কামনা করছিল। মনে হয় কয়েক যুগ ধরে রকিবের সঙ্গে ওর দেখা নেই। রকিব একমাথা বড় বড় চুল নিয়ে ওর সামনে। দাঁড়িয়ে। জ্বলজ্বলে দৃষ্টিতে সুখের কাপন। সালমার বুকের ভেতর কথা আটকে যায়। রকিব মুখ খোলে আগে।
কোথায় যাচ্ছিস?
লাইব্রেরিতে।
পরীক্ষা দিবি?
হ্যাঁ।
কথাটা রকিব বিশ্বাস করতে পারে না। অবিশ্বাস্য কণ্ঠে আবার জিজ্ঞেস করে, পরীক্ষা দিবি?
হ্যাঁরে হ্যাঁ, তোর বিশ্বাস হচ্ছে না বুঝি?
সালমা এক পলক হাসে।
জানিস ওই কাগুজে ডিগ্রিটাকে সম্বল করে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে আমাকে।
কী বলছিস?
সে তুই বুঝবি না। তোর খবর কী? কেমন আছিস?
তোর কী মনে হয়? কেমন থাকতে পারি?
ওইসব প্যানপ্যানানি ছাড়।
তাহলে ধরে নে নিজেই।
তুই কেমন আছিস?
ভালোই।
সালমা।
বল? কী থামলি কেন?
থাক। এখন থাক। নিজের সঙ্গে নিজে আরো একটু বুঝে নিই।
রকিবের সামনাসামনি দাঁড়িয়ে সালমা শব্দ করে হাসে।
চল রকিব আমরা ওইদিকে গিয়ে বসি।
খুব যে সহজ হয়ে গেলি? ঠিক আছে চল।
দুজনে ঘাসের ওপর বসে। ছেলেমেয়েরা লাইব্রেরিতে যাওয়া-আসা করছে। মাথায় ওপর দিয়ে শব্দ করে প্লেন উড়ে যায়। আকাশটা হালকা মেঘের দরুন ছাই ছাই রঙের দেখায়। সালমা হঠাৎ করে আবার নিঃসঙ্গ হয়ে যায়। আজকাল যখন ওই বোধটা ওকে আঁকড়ে ধরে, তখন কাঁদতে ইচ্ছে করে। আশপাশে কেউ থাকলেও মনের সেই উথালপাতাল ভাব কাটে না। রকিব একদৃষ্টে ওর দিকে চেয়ে আছে। সালমা কপালের ওপর থেকে চুল সরায়। বাতাস বারবার চুল উড়িয়ে এনে কপালে ফেলে। রকিবের উজ্জ্বল চকচকে দৃষ্টি অনুসরণ করে সালমা আবার হাসে।
তুই যেন কী বলতে চেয়েছিলি এবার বল রকিব?
তোকে কি কখনো কোনো নিঘুম রাত যন্ত্রণা দেয় না সালমা?
তারপর।
সালমা তোর কি এখনো কোনো সময় হয়নি? আমি ভালোবাসা চাই সালমা। ভালোবাসা ছাড়া বাঁচতে পারি না।
রকিবের দৃষ্টিতে পেরোয়া ভাব। কণ্ঠে মিনতি। সালমা কথা বলতে পারে না। গলার কাছে কী যেন একটা আটকে থাকে। মনে হয় অনেক কথা রকিবকে ওর বলার ছিল। কিন্তু বলতে পারছে না। রকিবকে নিয়ে এক নির্জন দ্বীপে যাবার ইচ্ছে আছে ওর। কিন্তু ডাকতে পারছে না। সালমা অনবরত ড়ুবে যাচ্ছে। আর সমস্ত পরিপার্শ্ব এক বিরাট তিমির মুখ হয়ে যাচ্ছে। ও যেন দু’হাত দিয়ে সবকিছু ঠেকিয়ে রাখছে। ও যেন। সব বাধা অতিক্রম করে সাফল্যের বন্দরে পৌঁছতে চাইছে।
সালমা?
রকিব ওর হাতের কবজি সজোরে চেপে ধরে। চেহারায় এক জ্বলজ্বলে ঔদ্ধত্য ভাব। যেন ইচ্ছে করলে এখুনি সালমাকে উঠিয়ে নিয়ে চলে যেতে পারে। ওর হাতের পেশিতে অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবি কলকল করছে। সালমা সামান্য ব্যথাও পায়।
আহ্, রকিব ছাড়।
না।
চারদিকে ছেলেমেয়েরা ঘোরাঘুরি করছে?
তাতে আমার কিছু আসে যায় না।
তুই কি একটা সিনক্রিয়েট করবি?
দরকার হলে তাই করব।
সালমা মৃদু ধমকের সুরে কিছু অনুরাগ মিশিয়ে বলে, কী পাগলামি হচ্ছে ছাড় না।
রকিব হাত ছেড়ে দেয়। সালমা অনুভব করে সেই ভদ্র বিনয়ী রকিব আর নেই। ও এখন ভালোবাসার অধিকার চায়। পুরোপুরি অর্থে ভালোবাসা চায়। ও দুর্বিনীত হয়ে উঠতে চাইছে। আসলে ও সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেছে। শুধু আবেগে এখন আর বিশ্বাস নেই। ওর ভেতর ভয়ানক শক্তি কাজ করে। এ উপলব্ধি বোধের সঙ্গে সঙ্গে সালমা ঘামতে শুরু করে। কিন্তু দুজনের কেউই আর আগের সুত্র ধরে কথা বলতে পারে না। রকিব মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে তাকিয়ে থাকে। গাঢ় নীল রঙের ঘাসফুল একটুখানি ঝোপের মধ্যে আলো ছড়াচ্ছে। এত সুন্দর রঙটা, রকিব মনে মনে ভাবে, আমার অন্তরের ছায়া হয়ে মাথা উঁচিয়ে আছে। লম্বা লম্বা ঘাসের মাথায় লাল ফড়িং উড়ে উড়ে এসে বসে। সালমা ওই ফড়িং হতে পারে। আমি ফুল। রকিব ভাবল। আমরা এমন মধুর আনন্দঘন ছন্দে জীবনের বৃত্ত ভরিয়ে রাখতে পারি। জীবনটা তো এমনিই। কখনো ফুল। কখনো ফড়িং। কখনো জুতোর তলে মাড়িয়ে যাওয়া থেতলানো ঘাসের মতো। আহ, সালমা তুই কিছু বুঝতে পারছিস না। আসলে কিছু বুঝতে চাচ্ছিসও না। রকিবের গলা ধরে আসে। কষ্ট। কষ্ট। ওই গাঢ় নীল ফুলের মতো কষ্ট। ফুলটা যেমন ভালোবাসা। তেমনি বেদনাও। ওই ফুলটা সব।
০৮. দূরের সাদা দেয়ালের দিকে তাকিয়ে
সালমা দূরের সাদা দেয়ালের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ভাবল, জলিল মিয়া কাল একটা খরগোশের বাচ্চা নিয়ে এসেছিল। বলেছিল, আপামণি তোমার সুখ এনেছি। সালমা ওটার দিকে ভালো করে না তাকিয়েই বলেছিল, খাঁচায় রেখে দাও। এখন ওটাকে ভয়ানক দেখতে ইচ্ছে করে সালমার। নরম তুলতুলে পেলব শরীরে হাত বুলোতে ইচ্ছে করে। ওটাকে যদি বুকের খাঁচায় ঢুকিয়ে রাখা যেত? সালমা ভাবল জীবনটা তো এমনই। কখনো খাচা খালি থাকে। কখনো ভর্তি হয়ে যায়। অনবরত যাওয়া আসাই তো জীবন। রকিব তুই কিছু বুঝিস না। বুঝতেই চাস না। জীবন মানেই বাতাসের মতো এলোমেলো বওয়া। কখনো বৈশাখী। কখনো দখিনা পবন। দুটোই সমান। সালমার গলা ধরে আসে। কষ্ট। কষ্ট। ওই খরগোশের সাদা শরীরটার মতো কষ্ট। খরগোশের সাদা শরীরটা যেমন ভালোবাসা তেমনি বেদনাও। ওই খরগোশটাই সব।