বাইরে মা আর সাকিবের মৃদু কথা শোনা গেল।
দুজনেই হাসছে। সালমা গরজ করল না। সাকিব ঢুকল ওর ঘরে।
কীরে দিদিভাই কী করছিস?
দেখতেই তো পাচ্ছিস।
আজ খালার বাসায় গিয়েছিলাম।
কেন?
এমনি। বেড়াতে। যা মজা হলো না ওখানে। সব একদম ঠিক হয়ে গেল।
কিসের ঠিক?
ও কিছু না। যাই বাবা আবার আমার জন্য বসে রয়েছে কি না।
সালমা কোনো কথা বলল না। সাকিব যেমন এসেছিল তেমনি চলে গেল। ও এমন একটা ভাব কর যেন কোনো কিছুতেই ওর কোনো কৌতূহল নেই। তবে ভেতরে ভেতরে কিসের আয়োজন চলছে তা ও টের পেল। তুমি জাহিদ চৌধুরী আমার সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেবে? তুমি সিদ্ধান্ত নেবার কে? সেই ক্ষমতা কি তুমি অর্জন করেছ? তবু তোমার পরিবর্তনে আমি আনন্দিত। সব রকম পরিবর্তনই আমাকে আনন্দ দেয়। ভালো। দেখি তুমি কতদূর এগোতে পার। তোমাকে তো জানি চরিত্রের কোনো স্থিতি নেই। যেদিকে বাতাস বয় সেদিকেই এগোতে থাকো। উল্টো বাতাসের মুখোমুখি কি কোনোদিন দাঁড়িয়েছ? দাঁড়াওনি। কিন্তু আমি জানি কেমন করে উল্টো বাতাসের মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়। তুমি আজ জোর গলায় সিদ্ধান্ত গ্রহণের কথা ঘোষণা করেছ? বেশ ব্যাপার। বোঝা যাচ্ছে, তুমি শক্তি অর্জন করতে চেষ্টা করছ। করো, পারলে যা খুশি করো। তুমি তোমার মধুকণ্ঠকে বজ্রকণ্ঠে পরিণত করেছ। তুমি তোমার শ্যামল অন্তর রুক্ষ করেছ। আমার কিছু যায় আসে না তাতে। আমি ওইসবে কমই ভয় পাই। তুমি জানো না আমি কেমন মাল। তুমি যত কঠোর হবে আমি ততই শান্ত হয়ে যাব। বুঝবে না কোথা দিয়ে নতুন করে সুড়ঙ্গপথ তৈরি হবে। জাহিদ চৌধুরী তুমি অধ্যাপক। বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন পড়াও। সভা-সমিতিতে বক্তৃতা দাও। বই লিখে নাম করো। ভিজিটিং প্রফেসর হয়ে বিদেশে যাও। ছাত্র-পিটিয়ে মানুষ করার গৌরবে অহংকার বোধ কর। কৃতী ছাত্রকে নিয়ে জোর গলায় কথা বলে আরাম পাও। কিন্তু সত্যি করে বলো তো
জাহিদ চৌধুরী, তুমি নিজের সম্পর্কে কোনো সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছ কি না? আজ তুমি আরেকজনের সিদ্ধান্ত নেবার জন্য উঠেপড়ে লেগেছ। অথচ সেই ক্ষমতাই যে তোমার নেই তুমি তা একবারও তলিয়ে দেখছ না। আমি একটা সামান্য মেয়ে। তোমার ভাষায় একরত্তি মেয়ে। আমি নিজের সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে পারি। তোমার মতো। বেঁকেচুরে যাই না। তোমার মতো ভুল পথে গিয়ে দীনতার গ্লানিতে হাবুড়ুবু খাই না। আমি সালমা অনায়াসে সাগর সাঁতরাতে পারি।
আপামণি।
কী?
রাত কত হলো খেয়াল আছে? খাবেন না?
আমার খাবার এই ঘরে দিয়ে যাও আনুর মা।
খাবার টেবিলে সবাই বসে আছে। আপনাকে ডাকে।
বলো গে আমি একটু পরে খাব।
আনুর মা চলে যায়। দুলাইন পড়তে না পড়তে আবার আনুর মা আসে।
আপামণি সাব রেগে গেছেন। জলদি আসেন।
সালমা উঠে এলো। খাবার ঘরের পরিবেশ থমথমে। সাকিব মুখ নিচু করে খেয়ে চলেছে। মা জলিল মিয়াকে কী যেন আনতে বলছে। বাবা চোখ বড় করে বলল, তোমাকে কতবার ডাকতে হবে লিমা?
সালমা কথা না বলে চেয়ার টেনে বসে।
কথা বলছ না যে? বাবার কণ্ঠে জেদ।
আমি পড়ছিলাম। ঠিক করেছি পরীক্ষাটা দিয়ে দেব।
বড় চট করে সিদ্ধান্ত নিলে যে?
মনের মধ্যে কোনো দুর্বলতা নেই তো সেজন্য চট করেই সিদ্ধান্ত নিতে পারি।
কথাবার্তাগুলো সাবধানে বলো। তোমাকে আদর দিয়ে দিয়ে মাথায় তুলেছি।
আমি কোনোদিন তোমার আদর চাইনি। সালমার কণ্ঠে উষ্মা।
কী বললে?
যা বলেছি তুমি তো শুনতে পেয়েছ।
আহ্, সালমা চুপ করো।
মা ধমকে ওঠে। সালমা আর কথা না বলে খেতে আরম্ভ করে। জাহিদ চৌধুরী কিছুক্ষণ গুম হয়ে থাকে।
নাও, শুরু করো। তুমি বাবা হয়ে যদি মাথা গরম করো তাহলে চলে নাকি? ও তো বুদ্ধি হবার পর থেকে ধরে নিয়েছে যে, ও এই সংসার থেকে আলাদা।
জাহিদ চৌধুরী ততক্ষণে খেতে শুরু করেছে। রাগে উত্তেজনায় কথা বলতে পারে না। সালমা নির্বিকার। বারবার বাবার স্নেহময় শীতল কণ্ঠ জলের স্পর্শ নিয়ে কানে এসে লাগে। কিন্তু জাহিদ চৌধুরী একরত্তি মেয়ের কাছে হারবে না বলে কৌশল অবলম্বন করতে শুরু করেছে। তার জেদ চেপেছে। হ্যাঁ, মানুষের এই পরিবর্তন মন্দ না। তাতে জীবনে একটা বৈচিত্র্য আসে। সালমা অল্প খেয়ে উঠে পড়ে।
কী, হয়ে গেল? বাবার কণ্ঠ গম্ভীর।
হ্যাঁ।
এই মাংসগুলো খেয়ে ফেল। না খেলে ভালো করে পড়া যায় না। সালমা শিক্ষক-পিতার অযাচিত উপদেশ নির্বিবাদে শোনে এবং ধপ করে বসে পড়ে চেয়ারে চটপট মাংসের টুকর্কো খেয়ে নিয়ে উঠে যায়। সাকিবও ওর সঙ্গে সঙ্গে উঠে আসে বারান্দার বেসিনে দু’ভাইবোন। একসঙ্গে হাত ধুতে থাকে। সাকিবের মুখটা গম্ভীর। সালমা পরিবেশ। হালকা করার জন্য বলে–মিতালির খবর কীরে?
ভালোই আছে।
অনেকদিন দেখি না?
আমার সঙ্গে রোজই দেখা হয়।
অ। তা তুই মুখটা অমন হাঁড়ির মতো করে রেখেছিস কেন রে?
তোর অনেক আচরণ আমার পছন্দ হয় না দিদিভাই।
তাই নাকি? সালমা সকৌতুকে হাসে। তা আচরণটা সকলের সুবিধে মতো করাই বোধহয় ভালো। তাই নারে?
নিশ্চয়।
সাকিব জোর দিয়ে কথা বলে। ওর গলাটা ভরাট শোনায়। কিছুটা পুরুষ পুরুষও। সালমা অবাক হয়। মনে হয় ইদানীং সাকিব বোধহয় নিজস্ব করে কিছু ভাবছে। আর সেজন্যই ওর চোখ-মুখের লাবণ্য বিলুপ্ত হয়ে রুক্ষ ভাবটা ফুটে উঠেছে। সাকিব হাত ধুয়ে ওর নিজের ঘরে চলে যায়। খাবার ঘর একদম নীরব। বাবা-মা দুজনেই কেউ কোনো কথা বলছে না। সালমা ঘরে আসে। মৌরি মুখে পোরে। আবার বই নিয়ে বসে। কিন্তু বেশিক্ষণ পড়তে পারে না। বারান্দা থেকে সাকিবের গিটারের শব্দ ভেসে আসছে। মৃদু। পাখির পালকের মতো হালকা।