ক্লাসে যাবে না কেন?
ভালো লাগছে না।
শরীর খারাপ?
না।
তবে?
ইচ্ছে করছে না।
এইসব খামখেয়ালি ইচ্ছে-অনিচ্ছেগুলো কবে তোমার শেষ হবে বলতে পারো?
কোনো দিনও হবে না।
ফিক করে হেসে ফেলে সালমা। মা আর কথা বাড়ায় না।
নাশতা খাও গিয়ে। দশটা বাজে।
যাচ্ছি।
মা বেরিয়ে যায়। আসবে বিকেল চারটায়। সালমা খাবার ঘরে এসে ঢোকে। টেবিলের ওপর থেকে এক টুকরো পনির তুলে মুখে দেয়। হান্টার বিফও আছে দেখছি। এই জিনিসটা সালমার খুব প্রিয়। মা ওর জন্য প্রায়ই তৈরি করে। ও কী খেতে ভালোবাসে তার দিকে মার খুব নজর। তবু মার প্রতি তেমন কোনো নিবিড় আকর্ষণ খুঁজে পায় না। সালমা।
আপনাকে চা দেব আপামণি?
দাও।
কুণ্ঠিত ভঙ্গিতে বেরিয়ে যায় আনুর মা। সালমার মনে হয় একেও জানতে হবে। দেখতে হবে এর ভেতরে কী আছে। আজ সকাল থেকে চারপাশের মানুষগুলোকে কেন জানি নতুন করে দেখতে ইচ্ছে করছে সালমার। প্রত্যেকেরই একটা জগৎ আছে। সালমার নিজস্ব নিয়মের মতো মানুষগুলো বুঝি ঘুরছে। হান্টার বিফের টুকরোগুলো শেষ করে ফেলে ও। আর কিছু খেতে ইচ্ছে করে না। অথচ এক এক সময় পাগলের মতো খেতে ইচ্ছে করে। যা পাওয়া যায় তাই খেতে ভালো লাগে। আনুর মা চা নিয়ে আসে। কাপটা টেবিলের ওপর রেখে টেবিল পরিষ্কার করতে লেগে যায়। আজ একটা চিকন পাড়ের বেগুনি শাড়ি পরেছে ও। জায়গায় জায়গায় ময়লার দাগ। আনু নামের একটা মেয়ে আছে ওর। বিয়ে দিয়েছে। আনুর মা একটু অবাক হয়।
কী দেখেন আপামণি?
কিছু না।
সালমা চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে বারান্দায় আসে। সিঁড়ির ধারে বসে। সাকিব গুনগুন করে গান গাইছে আর ইউনিভার্সিটি যাবার জন্য তৈরি হচ্ছে। পড়াশোনায় ওর খুব একটা আগ্রহ নেই। গান-বাজনায় ঝোঁক। গিটার নিয়ে বসলে আর সব কাজ ভুলে যায়। মাঝে মাঝে সাকিব অনেক রাত পর্যন্ত বারান্দায় বসে গিটার বাজায়। তখন ঘুম আসে না সালমার। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে। মনটা ছটফট করে। মনে হয় ওর চারদিকে সব যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে আসছে। আর ওর পৃথিবী ক্রমাগত সংকুচিত হচ্ছে। ও একটা ছোট নিঃসঙ্গ দ্বীপের অচিন পাখি হয়ে গেছে। কোথাও যেতে পারে না। পুল ভেঙে গেছে–খেয়া ড়ুবে গেছে–ডানায় শক্তি নেই। আর তখনই ও বুকের তলে। বালিশ আঁকড়ে ধরে। একটা কিছু অবলম্বন চাই। একটু কিছু। মাঝে মাঝে ভয় হয় সালমার। মনে হয় সব যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে ও অনবরত ভূমিতলস্থ অন্ধকারে চলে যাচ্ছে। যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। চলার শেষ নেই। সামনে পেছনে ডানে বামে কেউ কোথাও নেই। আলো নেই। বাতাস নেই। ও যেন এক ফোঁটা আলো আর বাতাসের জন্য মরে যাচ্ছে। তখন চিৎকার করতে ইচ্ছে করে। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে যে, আমি হারিয়ে যাচ্ছি। আমাকে খুঁজে নাও। টেনে তোলো। পথ দেখাও, কিন্তু কেউ আসে না। সালমা জানে ওর বুকের এই নিঃসঙ্গতা ভরিয়ে দেবার ক্ষমতা কারো নেই। কেন এমন লাগে? এমন অদ্ভুত একপেশে যন্ত্রণা। কখনো নীলপাখি হয়। কখনো রঙিন প্রজাপতি অথবা কখনো সাকিবের গিটার হয়ে যায়।
মাঝরাতে সাবিকের গিটারটা যখন সমস্ত বাড়ি গ্রাস করে তখন সালমার একাকিত্ব তীব্র হয়। তখন বিছানা ছেড়ে উঠে আসে, সাকিবের পাশে চেয়ার নিয়ে বসে।
দেখে বাগান চুপ। সিঁড়ি চুপ। সব আস্তে আস্তে তলিয়ে যায়। সালমার তখন রকিবের কথা মনে হয়। রকিব যতই ওকে ভালোবাসুক, সেই ভালোবাসা সালমাকে স্পর্শ করে না। সালমার স্নায়ুকে সাকিবের গিটারের মতো বাজায় না। রকিবকে তখন একঘেয়ে বিরক্তিকর মনে হয়। সালমার আপন ভুবন ভীষণ ক্লান্তিতে নিশুপ পড়ে থাকে। সাকিবের হাতের দিকে তাকিয়ে থাকে একদৃষ্টে। অন্ধকারে তেমন পরিষ্কার দেখা যায় না। তবু মনে হয় ওই হাত যদি হৃৎপিণ্ডের তারকে এমন ঝংকারমুখর করে তুলতে পারত? কখনো বাড়ি বাগান সব মুছে গিয়ে এক বিরাট সমুদ্র জেগে ওঠে। হাত-পা শিথিল করে দিয়ে অথৈ পানিতে ভাসতে ভাসতে অনেক দূরে চলে যায় সালমা। রঙবেরঙের মাছ ঘুরে বেড়ায় চারদিকে। লাল সাদা সোনালি সবুজ হলুদ। কত বিচিত্র রঙের মাছ! মায়াবী এক জগতের মতো জনে হয় সবকিছু। নিঃসঙ্গ চেতনার পলেস্তারা কেটে যেতে থাকে ভেসে ওঠে নতুন জগৎ। সাড়া জাগানো। শব্দময়। সালমা তখন অতিরিক্ত একটা কিছু খুঁজে পায়। খুঁজে পায় আলোর ফোয়ারা। নিষিদ্ধ বাতাসের ঘ্রাণ। আস্তে আস্তে টেনে নিয়ে যায় সেই প্রত্যয়ে, যেখানে দাঁড়িয়ে সহস্র কণ্ঠে বলতে ইচ্ছে করে, আমি আছি। আমার অস্তিতের বাইরে আর কোনো মৌল সত্য নেই। সেই চেতনা সালমাকে উল্লাসের পরীর নাচ দেখায়।
প্রায়ই অনেক রাত হয়ে যায়, তবু ঘুম আসে না। গাঢ় রাত বাবা-মার নিশ্বাসের মতো গভীর হয়। সাকিবের বাজনা মৃদু হতে হতে থেমে যায়। কামিনীর ঝোপ থেকে পাখির ডানা ঝাপটানি ভেসে আসে। বারান্দার নিচ দিয়ে ইঁদুর চলে যায়।
দিদিভাই?
সাকিব আস্তে আস্তে ডাকে। জোরে ডাকার সাহস নেই।
অ দিদিভাই?
কী।
ঘুমাবি না?
তুই থামলি কেন সাকিব?
ঘুম পাচ্ছে।
ঘুম? এরপরও তোর ঘুম পায়? ওই বাজনাই তো তোর ঘুম।
অতশত বুঝি না।
তোকে আমার মেরে ফেলতে ইচ্ছে করছে।
ওঠ, উঠে ঘরে যা।
তুই আর একবার বাজাবি সাকিব?
না।
কেন?
ইচ্ছে করছে না।
তাহলে থাক।
সালমা শ্লথ পায়ে ঘরে চলে আসে। কিছুতেই আর ঘুম আসতে চায় না। এজন্যে কয়েকদিন সাকিবকে মারতে গিয়েছিল ও। রাগে-দুঃখে ওর গিটার ভেঙে ফেলতে চেয়েছিল। সাকিব শান্ত বলে ব্যাপার বেশিদূর গড়ায়নি। তবে এরপর দুদিন সাকিব সালমাকে না বলে নিঃশব্দে উঠে চলে গিয়েছিল। আর সারারাত সালমা বারান্দার চেয়ারের ওপর ঘুমিয়েছিল। ও টের পায়নি যে কখন সাকিব বাজনা থামিয়েছে। নিমজ্জিত চেতনার তলদেশ থেকে ফিরে না এসে ও আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পড়েছিল। দ্বিতীয় দিন সালমাকে ওই অবস্থায় বারান্দায় দেখে মা ভীষণ রাগারাগি করেছিল। এত বড় মেয়ে সারারাত বারান্দার চেয়ারের ওপর। কাটিয়েছে! মা ভাবতেই পারে না নিজের কপালকে ধন্যবাদ দিয়েছিল যে, কোনো দুর্ঘটনা হয়নি। বাবাও মুখ গম্ভীর করেছিলেন।