সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে দেখল, জাহিদ চৌধুরী বৈঠকখানায় বসে দুজন লোকের সঙ্গে কথা বলছে। সালমা নিজের ঘরে এলো। সটান শুয়ে পড়ল। গত সপ্তাহে জাহিদ চৌধুরী আমেরিকা থেকে ফিরেছে। বিদেশি জলবায়ু তার চেহারায় বেশ একটা ঝলমলে দীপ্তি দিয়েছে। জাহিদ চৌধুরীকে এখন আরো স্মার্ট এবং সপ্রভিত মনে হয়। কিন্তু বাবা কার সঙ্গে কথা বলছে? ও লোক দুটোকে সালমা আগে কখনো দেখেনি। বাজে ব্যাপার, ও নিয়ে ভাবার কোনো মানেই হয় না। বাবা যার সঙ্গে ইচ্ছে কথা বলুক তাতে সালমার কী এসে যায়। আর এসব অভ্যেস বড় খারাপ। মনকে উদার হতে বাধা দেয়।
সালমা চায়ের জন্য খাবার ঘরে এলো। কেউ নেই। মা আর সাকিবকে দেখল না। রান্নাঘরে এলো। আনুর মা, জলিল মিয়া পাশাপাশি ঘনিষ্ঠভাবে বসে। সালমাকে দেখে জলিল মিয়া উঠে দাঁড়াল।
কী চাও আপামণি?
চা খাব।
এই আনুর মা চা বানাও।
মা আর সাকিব কই জলিল ভাই?
তোমার খালাম্মার বাসায় গেছে। আম্মা তোমার জন্য ডিমের হালুয়া রেখেছে আপামণি। খাবার ঘরে এসো।
দুজনে খাবার ঘরে এলো। জলিল মিয়া কাঁধের গামছা দিয়ে টেবিলটা মুছে ফেলল। অন্যদিন যা সে করে না। সালমার মনে হলো জলিল মিয়া এক যেন একটু বেশি তোয়াজ করছে। সালমা মনে মনে হাসল। বুঝল কেন। ভাবল, একবার বলে ফেলে যে এসবের প্রয়োজন নেই জলিল ভাই। তুমি সহজেই থাক। আমাকে দিয়ে ভয় নেই। কিন্তু বলতে পারল না। বদলে চামচে করে ডিমের হালুয়া মুখে পুরল। জলিল মিয়া ফ্রিজ থেকে কলা বের করল, পানির বোতল বের করল। আনুর মা চা নিয়ে এলো। সালমা ইচ্ছে করে কথা ফাঁদল।
দেখো জলিল ভাই, আনুর মা আজকাল বেশ সুন্দর হচ্ছে।
জলিল মিয়া কথা বলতে পারল না। আনুর মা অনুচ্চ স্বরে বলল, কী যে বলেন আপামণি।
বিশ্বাস হচ্ছে না বুঝি? তুমি একবার আমার ঘরে আয়নায় গিয়ে দেখো। আজকাল তোমাকে একদম অন্যরকম লাগে। তুমি কিছু বলছ কেন জলিল ভাই? বলো না, আমার কথা সত্যি কি না?
জানি না। আমি মূর্খ মানুষ, অতশত বুঝি না।
জলিল মিয়া আমতা আমতা করে।
সালমা শব্দ করে হেসে ফেলে। আর হাসি চেপে রাখা যায় না।
তুমি খুব চালাক হয়ে গেছ জলিল ভাই। বুঝলেও বলবে না। আনুর মা ততক্ষণে ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে। বেচারি লজ্জা পেয়েছে। টেবিলের ওপর সবকিছু গুছিয়ে দিয়ে জলিল মিয়াও আস্তে আস্তে কেটে পড়ে। সালমা কৌতুক বোধ করে। ওরা হয়তো এখন রান্নাঘরে বসে এ নিয়ে মজা করছে। সালমার মনে হয় দুজনের মধ্যে একটা সহজ প্রাণবন্ত ভাব এসে গেছে। দুজনে একটা নির্জন দ্বীপ আবিষ্কার করেছে। এবং অনেক ঢেউয়ের মধ্যে সাঁতরে খুঁজে পাওয়া সে দ্বীপে এখন নারকেলের চিরল পাতার মৃদু বাতাসের শান্তি। সে দ্বীপের সবুজ ঘাসে রঙিন ফড়িংয়ের মেলা। কূলে বসে সাগরের ঢেউ গুনতে গুনতে ওরা কি অতীতকে স্মরণ করে? না, ওরা অনাগতের স্বপ্ন দেখে। সেজন্যই ওদের ভাষার দৃষ্টি স্বাপ্নিক চেহারায় নিজেদের অজান্তেই ফুটে উঠেছে মায়াবী জাদুর স্পর্শে। যে স্পর্শ নিয়ে ওদের নতুন জন্ম, সেখানে আর সব মিথ্যা। সালমার মনে হয়, ওরা ব্যর্থতাকে অতিক্রম করতে পেরেছে। হয়তো কখনো মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে সাকিবের গিটারের মতো টুকরো স্মৃতি টুংটাং করে ওঠে। তাতে কী! সে বেদনা থাকে বলেই তো জীবেনর উপভোগ নিবিড় হয়। সালমা চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে তন্ময় হয়ে থাকে। ভাবতে ভাল লাগে যে দুটি পোড়খাওয়া মানুষ আবার একটি জগৎ গড়তে পেরেছে। জীবনকে ছিনিয়ে নিয়েছে।
চা খেয়ে সালমা নিজের ঘরে আসে। টেবিল ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে বই নিয়ে বসে। ফ্রেজারের গোল্ডেন বাউ। এ বইটা কয়েকদিন ধরে ও খুব মন দিয়ে পড়ছে। পড়তে ভালো লাগে। পড়তে পড়তে বেদনা ভুলে যায়। সালমার মনে হয় এই একটা চমৎকার ভুবন। কোনো একটা অবলম্বন না খুঁজতে গিয়ে বই নিয়ে বসে থাকা অনেক ভালো। ভাবনার দিগন্তসীমা ক্রমাগত বাড়তে থাকে। বাড়তে বাড়তে একসময় নিজের অস্তিত্ব পর্যন্ত ভুলিয়ে দেয়।
আনুর মা এসে ঘরে ঢোকে।
আপামণি, সাহেব আপনাকে ডাকে।
কেন?
আমি তো জানি না।
আনুর মা সালমার ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় নিজেকে ঘুরিয়ে। ফিরিয়ে দেখে। দেখে দেখে সাধ মেটে না। সালমা মুখ টিপে হাসে। ওর বিকেলের কথাগুলো এখন আনুর মার মনের মধ্যে কাজ করছে। ও পরক্ষণে সালমা সম্পর্কে সচেতন হয়ে দাঁত দিয়ে জিভ কেটে বেরিয়ে যায়।
সালমা ভেবে পায় না যে বাবা কেন ডাকল। ও বারান্দায় এসে একটুক্ষণ দাঁড়ায়। ড্রয়িংরুমে বসে রয়েছে বাবা। লোক দুজন চলে গেছে। সালমা ঘরে ঢুকে সোফায় বসল। বাবার মুখটা গম্ভীর। থমথমে।
কী করছিলে?
পড়ছিলাম।
পরীক্ষা কবে?
সামনের মাসের পনেরো তারিখ।
পরীক্ষা দেবার মতো প্রিপারেশন হয়েছে?
এখনো বুঝতে পারছি না।
কবে পারবে?
দিন পনেরো পর।
তোমার মেধার ওপর আমার আস্থা আছে। তবু যদি পরীক্ষা দেবার মতো অবস্থা তৈরি করতে না পার তবে আমাকে জানিয়ে। সে অনুযায়ী আমি আমার সিদ্ধান্ত নেব।
সিদ্ধান্ত।
সালমা চমকে উঠে চোখ বড় করে। বাবা হাতের কাগজের ওপর দৃষ্টি নামিয়ে রেখেছে। সালমার সঙ্গে আর কোনো কথা বলার ইচ্ছে তার নেই। ও সেটা বোঝে। তবু একটু জোর দিয়ে বলে, কিসের সিদ্ধান্ত?
সে তোমার এখুনি জানার দরকার নেই। সময়মতো জানাব। যাও, পড়গে।
বাবার রূঢ় আচরণের জন্য সালমা প্রস্তুত ছিল না। একদম হকচকিয়ে যায়। এতদিনের ঠাণ্ডা স্নেহময় কণ্ঠ আজ কী কারণে পরিবর্তিত হয়ে গেল ও তা বুঝতে পারছে না। তবু বাবাকে আর কোনো কথা জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হয় না। নিঃশব্দে উঠে আসে। মনে মনে হাসে। বিদেশ থেকে বাবা কি একটা বিদেশি মেজাজও সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে? নাকি ওদেশে জ্ঞান বিতরণ করতে পারার গৌরবে অহংকারে পেয়ে বসেছে। যাকগে। ওইসবে সালমার কিছু যায় আসে না। কিন্তু মন থেকে ওড়াতে চাইলেও সবকিছু ওড়াতে পারল না। সিদ্ধান্ত শব্দটা মনের মধ্যে দৌড়ে বেড়ায়। কিসের সিদ্ধান্ত? জাহিদ চৌধুরীর ক্ষমতা সম্পর্কে তো ওর জানা আছে। বড়জোর ওকে একটা বিয়ে দিয়ে দিতে পারে। এর বেশি আর কী করবে? সেটা যদি করেই তার জন্য সালমার কোনো পরোয়া নেই। সেটা নিয়ে জাহিদ চৌধুরীর মুখখামুখি হতে পারার মতো মনের জোর ওর আছে। আর তখুনি সালমা ঠিক করে ফেলে যে পরীক্ষাটা দিয়ে দেবে। যা সময় আছে সে সময়টুকু ও পুরোপুরি কাজে লাগালে ও একটা ভালো সেকেন্ড ক্লাস পেয়ে যাবে। কিন্তু পরক্ষণে মনটা খারাপ হয়ে যায়। এখন থেকে কেবল মাপা মাপা ছাঁকা ঘঁকা বই পড়তে হবে। ইচ্ছেমতো যেটা খুশি সেটা আর টেনে পড়া যাবে না।