সালমা আবার বিছানায় শুলো। মোমটা নেভাল না। বাতাসে কাঁপতে কাঁপতে ওটা একসময় নিভে যাবে। যতক্ষণ নিভবে না ততক্ষণ সারা ঘরে একটা লম্বা ছায়া এপাশ-ওপাশ করবে। সেদিকে তাকিয়ে থেকে অনেক সময় যায়। তবু ঘুম আসে না। এখন কী করছে ওরা। ওরা কি রঙের সাগরে পানসী ভাসিয়েছে? হঠাৎ সালমার চোখের সামনে থেকে দ্রুত অন্ধকার সরতে থাকে। অনবরত থাকে। এ সত্যটা একবারও সালমার মনে হয়নি। আশ্চর্য, কী করে ভুলে গেল ও! আজ রাতে ওরা বীজ বুনবে। উত্তেজনায় সালমা বিছানায় উঠে বসে। বীজ বোনার জন্যই তো ওদের এত আয়োজন। ওদের চারপাশে এত রং। বীজ বোনার জন্যই তো ওদের জীবনে রঙের আবির্ভাব। ওদের চোখে এখন ফসলের স্বপ্ন। ফসলের সোনালি ঐশ্বর্য। এতদিন ওরা যা করেছে তাতে যত আনন্দই থাকুক সৃষ্টির উল্লাস ছিল না। সৃষ্টি আজ ওদের কাছে মহিমান্বিত হবে। ওদের ফসলের জমি বৃষ্টির তোড়ে ভেসে যাচ্ছে।
বাতাসে কাঁপতে কাঁপতে মোমটা নিভে যায়। সারা ঘরে জমাট অন্ধকার ছড়িয়ে থাকে। সালমা শুয়ে পড়ে। উত্তেজনা শান্ত হয়ে গেছে। প্রশ্নের উত্তর মিলেছে। মূল সূত্রটা ধরতে পারছে না বলে এত গড়বড়। ওদের সারাদিনের আচরণের একটা অর্থ খুঁজে পায় সালমা অথচ এটা ওর আগেই মানে হওয়া উচিত ছিল। শুয়ে শুয়ে নিজের আঙুল কামড়াল। যে সত্যের জন্য জীবনের সমস্ত অর্থটাই পাল্টে নিল ওরা সেটাই সালমার মগজে ঢুকছে অনেক পরে। তবু একটা স্বস্তি পেল ও। কিছু প্রশান্তিও যেন।
আর তখনই রোদ পোড়া-মাঠে আকাঙ্ক্ষিত বৃষ্টির মতো ঘুমের ধারা নামল। আর কিছুই জানল না সালমা।
০৭. নিঃসঙ্গতা ছাড়া আর কোনো সঙ্গী নেই
সালমা ভেবে দেখল নিঃসঙ্গতা ছাড়া এখন আর ওর কোনো সঙ্গী নেই। সারাক্ষণই একলা হয়ে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল ছেলেমেয়ের মধ্যে চলতে চলতে ও অনুভব করে নিরন্তর শূন্যতা। চারপাশে এত লোক, এত হাসি, এত প্রাণবন্যা, তবু কী যেন নেই। চোখ বুজে শুয়ে থাকলে বুকটা চেপে আসে। মুচড়ে ওঠে। তারপর কাঁদতে ইচ্ছে করে। জোর বাতাস বইলে কান্না আসে। বৃষ্টি হলে কান্না আসে। তখন সালমা অনবরত মনের সমুদ্রে সাঁতরায়। সাঁতরাতে সাঁতরাতে ক্লান্ত হয়ে যায়।
বই-খাতা বুকে নিয়ে রোজ বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে হয়। লেকচার শুনতে হয়। পরীক্ষা এগিয়ে আসাতে সবাই ব্যস্ত। রকিব ওকে এড়িয়ে চলে। দেখা হলেও কথা বলে না। চোখাচোখি হলে দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরিয়ে নেয়। সালমা নিজে থেকেও কথা বলে না। উৎসাহ পায় না। বান্ধবী নাজ একদিন যেচে বলে, তেদের কি ঝগড়া হয়েছে সালমা?
ঝগড়া? সালমা চোখ কপালে’তোলে, যেন এ শব্দটা নতুন শুনছে।
না, আমরা সবাই দেখছি, রকিবের সঙ্গে তোর আর তেমন ভাব নেই। দুজনে কেমন ছাড়া ছাড়া।
ও এই। সালমা জোর করে হাসে, হাসতেই থাকে।
অত হাসির কী হলো?
তোরা যে আমাদের ওপর বেশ নজর রেখেছিস, সেটা জেনে খুশি হলাম।
রকিব মনমরা হয়ে গেছে।
কাপুরুষ। জীবনকে ফেস করতে পারে না।
নাজ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে।
এতদিন ধরে তোর সঙ্গে বন্ধুত্ব, তবু তোকে বুঝতে পারলাম না সালমা।
সেটা হলে তো আমাদের কোনো সমস্যাই থাকত না।
রকিবের জন্য তোর খারাপ লাগে না?
মাঝে মাঝে লাগে।
একসময় তুই ওর জন্য পাগল ছিলি।
সময় তো ফুরিয়ে যায়নি।
কী জানি বাবা বুঝি না।
নাজ হাত ওল্টায়। সালমা হাসে।
যাক তোকে অত বুঝতে হবে না। চল নাজ, সিনেমা দেখে আসি, একটা ভালো বই হচ্ছে মধুমিতায়।
কী বই?
স্পার্টাকাস।
ও খুব ভালো। চল।
সিনেমা হলের অন্ধকারে সালমা আবার নিজের অন্তর হাতড়ায়। মনে হয় নিজ অন্তরের সব সীমানা ভেঙে গেছে। তেপান্তরের মাঠের মতো। এলোপাতাড়ি বাতাস বয় কেবল। রকিব একটা দুরন্ত রাগী যুবক হতে পারে না। সিনেমার নায়কের মুখটা সালমার অন্তরে ঘোরাঘুরি করে। নায়িকার নীল পোশাক সালমাকে পেলব অনুভূতিতে ছেয়ে দেয়। ওদের ভালোবাসা? সালমা ভাবতে পারে না। ওদের বিদ্রোহ? ওদের যুদ্ধ আর তখনই মুখ দিয়ে বেরিয়ে যায়। রকিব তুই, কিছু না। আচ্ছা রকিব, তুই কেন আমার ওপর জোর করলি না? তুই কেন আমাকে বুনো ঘোড়ার ওপর চড়িয়ে দিগ্বিদিক ছুটে গেলি না? আমি তো সেই রকম একটা যুবক চাই। কাউকে আমার ভালো লাগে না। কাউকে না। অতৃপ্ত আকাক্ষা আমার বুকের ভেতর তুষের আগুনের মতো জ্বলে। আমি জীবনটাকে টুকরো টুকরো ছিন্নভিন্ন করতে চাই। জীবনের পেলব অনুভূতির নীল সরোবরে আমার ঘৃণা। তুই সব জানিস রকিব। আসলে তুইও আমাকে বুঝতে পারিস না। সে জন্যই নীরবে সরে গেছিস। দুর্বল ভাবাবেগ নিয়ে কেউ কোনোদিন জিততে পারে না। পদে পদে ঠকে পায়ে পায়ে মার খায়। তোর মধ্যে আমি এক শক্তিমান পুরুষ দেখতে চাই রকিব।
এই সালমা? কী বিড়বিড় করছিস?
নাজ ওকে ধাক্কা দেয়। সালমা আবার পর্দার ওপর ফিরে আসে। সিনেমার নায়ককে তখন কুশিফাই করা হচ্ছে। নাজের প্রশ্নের কোনো জবাব দেয় না ও। এ বইটা এর আগে দুবার দেখেছে। যতবার দেখে ততবারই ওর নতুন লাগে। আজ সিনেমা হলের অন্ধকারে এক গাদা লোকের সঙ্গে বসে থেকে কেবলই নিজের সঙ্গে মুখোমুখি হতে ইচ্ছে করে সালমার। নিজের সঙ্গে তন্ময় হয়ে কথা বলার মধ্যেও একটা আনন্দ আছে। আশপাশের অসংখ্য লোক যখন পর্দার বুকে দৃষ্টি ফেলে দিয়ে নিঃসাড়, ও তখন মাকড়সার মতো জাল বোনে। বিচিত্র সে জাল। চিকন সুতো অনবরত মনের লাটাই ছেড়ে বেরিয়ে আসে। সে সুতোয় নকশা হয়। চিকন সুতোয় জাল বোনা মাকড়সার মতো কি ও নিজেই সে জালে জড়িয়ে যাচ্ছে?