আমি কেন নাসিমা’পাকেই জিজ্ঞেস করুন না?
ওর কি এখন পছন্দের সময় আছে? ও তো এখন যেটা দেখবে সেটাই পছন্দ করবে। কী বলো নাসিমা?
বেশি বাজে বোকো না। তোমার বন্ধু হাশেমকে আসতে বলা হয়নি?
তুমি বলে দাও। টেলিফোন গাইডের উল্টো পিঠে নাম্বারটা আছে দেখো।
সাব্বির হাত-পা ছড়িয়ে সোফায় এলিয়ে পড়ে। বুড়ি ঝি চা দিয়ে যায়। গুনগুনিয়ে গান গায় সাব্বির। সালমার মনে হয় এখানে থাকলে মাথা খারাপ হয়ে যাবে ওর। এদের কারোরই নাড়ির সূত্র ধরতে পারছে না ও। এরা আজ অন্য জগতের বাসিন্দা।
মুখটা অমন গম্ভীর করে বসে রয়েছে কেন সালমা?
কই? না। সালমা জোর করে হাসার চেষ্টা করে।
উঁহু তোমার মনটা আজ খারাপ বোধহয়?
মোটই না। সালমা হেসে ওঠে।
বেশ তাহলে গান বাজাও।
সালমা চেঞ্জার চালায়। সাব্বির জুতোসুদ্ধ টেবিলের ওপর পা উঠিয়ে দেয়। পা নাচায় আর চা খায়। পা নাচায় আর গান শোনে।
টেলিফোন করা শেষ করে নাসিমা চেঁচিয়ে ওঠে, তুমি আমার নতুন টেবিলক্লথের ওপর পা তুলে দিয়েছ সাব্বির?
আমার এই পা জোড়ার চাইতে তোমার টেবিলক্লথটাই কি বড় নাসিমা?
কথা তো সেটা নয়। কথা হলো, কেতাদুরস্ত থাকা।
বেশ এই পা নামাচ্ছি। তবে জেনে রেখো নাসিমা, আমার এই খ্যাপামি কিন্তু তোমার সাজানো গোলাপ বনে মাতাল বাতাসের মতো।
তা কি আর জানি না।
নাসিমা সাব্বিরের আনা প্যাকেটগুলো উঠিয়ে নিয়ে শোবার ঘরে চলে যায়। সালমা জানালা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকে। গান শুনেও শোনে না। মনে ঝড়। আজ ওদের এত আনন্দ কিসের? এর উৎস কোথায়? ভোগ? তা কেন হবে? দুজনেই তো একত্রে বাস করছে। সেটায় তো কোনো বাধা ছিল না। সামাজিক স্বীকৃতি? সেটার জন্য তো ওদের খুব মাথাব্যথা নেই। তবে কী? কিসের জন্য ওদের এত রঙের ঝরনা বইছে? সালমা কিছুতেই উত্তর খুঁজে পায় না। বাইরে আলো কমে আসছে। আমগাছের মাথার ওপর মরা রোদ। সময় এগোচেছ। সালমার বুক কাঁপে। আর কিছুক্ষণ পর–আর কিছুক্ষণ পর। না থাক। দূরে এক সারি সাদা বক উড়ে যায়। আকাশে ঘেঁড়া মেঘের দল।
অ্যাই সালমা, তুমি কী ঘুমোচ্ছ নাকি?
কী যে বলেন সাব্বির ভাই!
সালমা হেসে সহজ হবার চেষ্টা করে।
আপনি আজকে একদম ছেলেমানুষ হয়ে গেছেন।
তাই নাকি?
সাব্বির হেসে ওঠে।
অ্যাই নাসিমা, দেখো সালমা আজ কেমন মুরব্বি হয়ে গেছে।
সালমা তুই আমার এখানে চলে আয়।
সেই ভালো।
সালমা শোবার ঘরে যায়। নাসিমা কাপড়, গয়না, প্রসাধনী সব বের করে খাটের ওপর সাজিয়েছে। শোবার ঘরের দেয়ালে টাঙানো পেইন্টিংটা পর্যন্ত বদলিয়েছে নাসিমা। খাটজুড়ে ফুলের মালা আর। ফুলের পাপড়ি ছড়ানো।
সালমার মনে রকিবের চিন্তা ঘুরপাক খায়। রকিব আর কোনোদিন ওর খোঁজ করেনি। সালমার মনে হয় ওর কোনো ভালোবাসার জগৎ নেই। ভালোবাসার অধিকারকে অস্বীকার করতে গিয়ে ও ভালোবাসা হারিয়েছে।
তুই বোস সালমা, আমি আসি।
নাসিমা ড্রইংরুমে যায়। সালমা শাড়ি, গয়না, প্রসাধনীর দিকে অর্থহীন দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকে।
সন্ধ্যা ঘনায়। একে একে বন্ধুরা আসে ওদের ছোট বাসায় ঠাসাঠাসি করে লোকে। কাজি আসে। বিয়ে পড়ানো হয়ে যায়। সালমা মনের মতো করে নাসিমাকে সাজায়। মনে হয়, একটা ইচ্ছের পাখির গায়ে পালক পরাচ্ছে ও। সেই ইচ্ছের পাখি নাসিমার লাল বেনারসি শাড়ির মতো উজ্জ্বল ঐশ্বর্যময়। চন্দনের গন্ধ সালমাকে আবিষ্ট করে রাখে। রাতের খাওয়া খেয়ে অতিথিরা চলে যায়। রাত বেশি হয়নি। বাড়ি ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। সালমা ছটফট করে। একসময় ওদের কাছে বিদায় নিয়ে ও নিচে নেমে আসে। প্রতিটি সিঁড়ির ধাপ এক একটি দীর্ঘ মরুভূমির মতো মনে হয় সালমার। মনে হয় ভয়ানক এক লু হাওয়ার ভেতর দিয়ে পেরিয়ে এলো ও। ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত, বিধ্বস্ত। বারান্দায় মা আর সাকিব বসেছিল। আজ ওদের কোনো ভয় পেল না সালমা। মার পাশের চেয়ারটায় ধপ করে বসে পড়ল। কৌতূহলী সাকিবই প্রশ্নটা করে আগে, ওপরতলায় কী হলো দিদিভাই?
আজ ওদের বিয়ে হলো।
বিয়ে।
মার বিস্ফারিত দৃষ্টি সালমার মুখের ওপর এসে পড়ে।
বিয়েই যখন হলো তখন এত খেমটা নাচের কী দরকার ছিল?
মা বিচিত্র মুখভঙ্গি করে গুহ করে। সালমা চুপচাপই থাকে। বলবার কী আছে! মার দৃষ্টিভঙ্গিই আলাদা। যারে দেখতে নারি তার চলন বাঁকা জাতীয় মনোভাবে কারো সপক্ষে কিছু বলা শোভন নয়। সালমা শব্দ করে হাই ওঠায়।
ঘুমুতে যাও লিমা।
হঠাৎ করেই ও প্রশ্ন করে, তোমরা কি আমার জন্যই বসেছিলে?
নয়তো কী? তোকে যে আমি দোতলায় যেতে দেখেছি দিদিভাই। নইলে তো মা আমাকে বাইরে খুঁজতে পাঠাচ্ছিল।
অ।
সালমা ঘরের দিকে হাঁটতে থাকে। সাকিবও উঠে চলে যায়। মা বসে থাকে। রান্নাঘরে আনুর মার কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত মা বসে থাকবে। সালমা দরজা বন্ধ করে দেয়। লাইট অফ করে। তারপর শুয়ে পড়ে। বাতাসে নেটের মশারি কাপে। আমড়া গাছে লক্ষ্মীপেঁচা ডাকে। সালমার ঘুম আসে না। আপ্রাণ চেষ্টা করে, তবু ঘুম আসে না। বৃষ্টির স্রোতের মতো দোতলার ঘরটা ভেসে যায়। এক টুকরো ছবি হয়ে যায়। ওরা এখন কী করছে? সালমা ভাবতে চাইল। বালিশের নিচে থেকে হাতঘড়িটা দেখতে চেষ্টা করল; পারল না। চাদের যে তেরছা আলো ঘরে এসে ঢুকেছে তাতে ঘড়ি দেখা যায় না। বাগানের হাস্নাহেনা গাছ থেকে মিষ্টি গন্ধ ভেসে আসছে। সালমা জোরে জোরে শ্বাস নিল। না ঠিক তেমন গন্ধ নয়, যে গন্ধ ওদের বিছানায় ছড়ানো ফুলের ভেতর থেকে উঠে আসছিল। সে গন্ধটাও ছিল নতুন। ঘুরেফিরে সালমার মনের ভেতর একরাশ রং কখনো দলা হয়ে, কখনো টুকরো হয়ে ভাসতে লাগল। দোতলার ঘর দুটি যেন রঙের আকাশ হয়ে গেল। সালমা আবার ভাবল, ওরা এখন কী করছে? গান শুনছে না শুয়ে শুয়ে গল্প করছে? নাকি… সালমা আর ভাবতে পারল না। অন্ধকার ঘরে একা একা লজ্জা পেল। লজ্জায় বালিশে মুখ গুজে রইল। মনে হলো, কোনোকিছুই তো ওদের জন্য নতুন কোনো ঘটনা নয়। তবু ওদের চারপাশে এত বর্ণ কেন? ওরাই বা কেন এত বর্ণোচ্ছল? দোতলায় শব্দ হলো। হয়তো চেয়ার টানার। সালমা কান খাড়া করল। না আর কোনো শব্দ নেই। আবার চারদিক নিঝুম। সালমা বিছানা ছেড়ে উঠল। টেবিলের ড্রয়ার হাতড়ে মোম বের করে জ্বালল। ঘড়ি দেখল। রাত একটা। বেশ রাত হয়েছে অথচ ঘুম আসছে না। বাথরুমে ঢুকে মুখ হাতে পানি দিল। মোমটা বাতাসে কাঁপছে। সালমা কখনো কখনো লাইটের বদলে মোম জ্বালায়। চোখ ধাধানো আলো ওর ভালো লাগে না। অনেক রাতে সুইচ টিপে লাইট জ্বালালে মনে হয় সূক্ষ্ম অনুভূতি থেকে ও আলগা হয়ে গেছে।