দেখো জলিল ভাই, কী সুন্দর! কবে হলো?
গতকাল।
আমাকে আগে বলোনি কেন?
তুমি এদিক-ওদিক যাও, এজন্য আর বলা হয়নি।
কিন্তু, কিন্তু জলিল ভাই আমার সুখ কই?
তোমার সুখ আজ সকালে মরে গেছে।
অ।
সালমার মুখ দিয়ে দুঃখ-ধ্বনি বের হয়। ও এতক্ষণে বাক্সটার দিকে ভালো করে তাকায়। মনে হয় বাক্সটার সমস্ত পরিবেশ বদলে গেছে। বাক্সজুড়ে ময়লা-নোংরা। দুধের আর পানির বাটি উল্টে পড়ে আছে। দুঃখ এক কোনায় চুপচাপ বসে ঝিমুচ্ছে। অন্যদিন হলে ও দৌড়ে সালমার কোলে এসে উঠত। আজ কোনোকিছুতেই আগ্রহ নেই। সালমার দিকে ভালো করে চেয়ে দেখছে না।
বাচ্চা হবার পরই তোমার ওই খরগোশটা কেমন জানি নেতিয়ে পড়েছিল আপামণি। আজ সকালে এসে দেখি মরে পড়ে আছে। আমি দূরে ফেলে দিয়েছি। জানি, ওটা দেখলে তোমার মন আরো খারাপ। হবে।
সালমা একটাও কথা বলতে পারে না। ঘুরেফিরে খরগোশ দুটোর কথাই মনে হয়। অনেক নির্জন সময়ে ওদের খেলা দেখে ওর সময়। কেটেছে। এখন একটা নেই। তার বদলে দুটো বাচ্চা দিয়ে গেছে। সালমা বাচ্চা দুটো বাক্সের ভেতর ঢুকিয়ে দেয়।
তোমার চিন্তা নেই আপামণি, ওই পুরুষটার জন্য আর একটা জোড় খুঁজে নিয়ে আসব। সালমা বাক্স বন্ধ করতে গিয়ে জলিল মিয়ার মুখের দিকে তাকাল।
বাচ্চাগুলোর যত্ন নেওয়া দরকার। ওগুলো আবার যেন মরে না যায়।
সালমা উঠে হাঁটতে আরম্ভ করে, কেবলই মনে হয় একটা কথা। ঘূর্ণিতে পড়া পাতার মতো কথাটা মনের মধ্যে ঘুরপাক খায়। সুখ মরে গেছে। আজ সকালে সুখ মরে গেছে। কখনো কখনো কারো কারো সুখ মরে যায়। সুখ পড়ে থাকে মুখ থুবড়ে। সালমা একবার আঙুরলতার পাশে দাঁড়াল। গাছে ছোট ছোট ফল হয়েছে। ছুয়ে দেখল ও। না কোথাও দাঁড়িয়ে স্বস্তি পাচ্ছে না।
সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে এলো।
নাসিমা ওকে দেখে হাসল, তোর কথাই ভাবছি সালমা।
কী ব্যাপার, সবকিছু নতুন লাগছে নাসিমা’পা?
হ্যাঁ, সবকিছুই নতুন করে ফেলেছি।
নাসিমা মিটমিটি হাসে। রজনীগন্ধার বড় ভঁটার ওপর মুখটা নামিয়ে রাখে। সালমা অবাক হয়। নাসিমা আজ যেন মনপ্রাণ ঢেলে সবকিছু সাজিয়েছে। টেবিলক্লথ, সোফার কভার, পর্দা, ছাইদানি, ফ্লাওয়ার ভাস সবকিছু নতুন। এমনকি ফুল সাজানোটাও। নাসিমা এর আগে কখনো। এমন করে ফুল সাজায়নি।
তুই অবাক হয়েছিস না সালমা?
শুধু কী অবাক? আমি কিছু বুঝতে পারছি না নাসিমা’পা।
আজ আমাদের বিয়ে।
বিয়ে!
সালমা তিড়িং করে লাফ দিয়ে ওঠে। নাসিমাকে জড়িয়ে ধরে একটা ঘুরপাক খায়।
সাব্বির ভাই কই?
ও বেরিয়েছে কিছু কেনাকাটা করতে।
কখন বিয়ে?
সন্ধ্যায়।
কে কে আসবে?
বেশি কেউ নয়। আমাদের কয়েকজন বন্ধুবান্ধব।
আজ তোমাকে আমি সাজিয়ে দেব নাসিমা’পা?
দিস।
নাসিমা অন্য কাজে মন দেয়। সালমা সোফার ওপর এসে বসে। ওর দৃষ্টি সরে সরে যায়। কখনো ফুলদানিতে, কখনো জানালার পর্দায় অথবা কখনো সোফার পিঠে সুতো দিয়ে ফুটিয়ে তোলা ফুলের ওপর। সালমার কেমন অস্থির লাগে। বারে বারে কর্মরত নাসিমাকেই দেখে। নাসিমার গাল দুটো ডালিমের মতো টকটক করছে। এত রং কোথা থেকে এলো! নাসিমাকে সুখী দেখাচ্ছে।
তোমার এখন কেমন লাগছে নাসিমা’পা?
ভেবে দেখিনি তো।
ভেবে দেখো না একবার?
দাঁড়া দেখছি। নাসিমা এক মুহূর্ত চিন্তা করে। এখন আমার নিজেকে খুব অহংকারী মনে হচ্ছে সালমা।
আচ্ছা নাসিমা’পা বিয়ের কি তোমার খুব দরকার ছিল?
ছিল।
কেন?
আমি মা হতে চাই সালমা। ওই শিশুর জন্য আমার জীবনের একটা পরিণতি দরকার।
সালমার মনে হলো নাসিমা’পাকে আজ ভীষণ লাজুক লাজুক দেখাচ্ছে। পিঠের ওপর ফাঁপানো চুলের গোছা উপচে পড়া খুশির মতো মাতোয়ারা। সালমা দৃষ্টি ফেরাতে পারে না। নাসিমা একসময় মুখ তুলে জিজ্ঞেস করে, কীরে?
কিছু না।
সালমা দৃষ্টি ঘুরিয়ে নেয়। লজ্জাও লাগে। নাসিমা’পা কী ভাবল কে জানে! নাসিমা জীবনের কথা নতুন করে ভাবছে। এক মেরু থেকে আর এক মেরুতে যাত্রা শুরু করেছে। নাসিমার সামনে এখন অনাগত সন্তানের ছবি। তাহলে নাসিমা’পা কি তার ব্যর্থতাকে অতিক্রম করে চলল?
নাসিমা’পা।
বল।
তোমার এই নতুন ভাবনা দিয়ে তুমি কি নিজেকে অতিক্রম করলে, তোমার পরাজয়?
আমি নিজেকে অতিক্রম করলাম। জীবনকে বাদ দিয়ে সুখ খোঁজা যায় না সালমা। অনেক তো দেখলাম, আর কত? পরাজয়ের কথা আমি। ভাবতে পারি না। পরাজিত যারা তারা পিছু হটে। আমি তো পিছু হটিনি। আমি তো সমান শক্তি নিয়ে নতুনকে গ্রহণ করতে যাচ্ছি। সে পথেও আমার জন্য অনেক গন্ধ ছড়ানো গোলাপ আছে।
সালমা হাসল।
তুমি অনেক পারো।
নাসিমা হেসে কাজে মন দিল। বুড়ি ঝি চা দিয়ে গেল সালমাকে। জেসমিন টি। চমৎকার গন্ধ আসছে।
তোমার চাতেও আজ অন্য স্বাদ নাসিমা’পা।
হবেই তো। সব ঢেলে সাজাচ্ছি যে!
হ্যাঁ, এমন জেসমিন টির মতো সুগন্ধময় হও তুমি।
বাব্বা তুই তো বেশ গুছিয়ে-গুছিয়ে কথা শুরু করলি সালমা।
সালমা একটু একটু করে চা খায়। গন্ধটা বেশ আরামদায়ক। নাসিমা টেলিফোনে কাকে যেন আসতে বলছে। তখুনি একগাদা প্যাকেট হাতে সাব্বির ঢোকে।
এই যে সালমা কী খবর?
কগ্রাচুলেশনস সাব্বির ভাই।
হুঁ, তুমি দেখি আগে আগে সব খবর নিয়ে বসে আছ। আমার জন্য কিছু বাকি রাখোনি।
এমন সুখবর কি কেউ বাকি রাখতে পারে সাব্বির ভাই?
তাই তো দেখো নাসিমা, সালমা কিন্তু খুব চালাক হয়ে গেছে। শুধু চালাক নয়, বাকপটুও হয়েছে। দেখো তো সালমা এই কাতানটা তোমার আপাকে কেমন মানাবে?