তাই থেকো।
সালমার কণ্ঠে উদাসীন নিস্পৃহতা। বেশি কথা বলতে ভালো লাগছে না।
তুই বোস সালমা, আমি তরকারিটা নামিয়ে আসি।
সালমা মোড়া টেনে বারান্দার ওপর বসে। ভাবির বড় মেয়ে এসে সামনে দাঁড়ায়।
সিলেটে অনেক কমলালেবুর বাগান আছে না ফুপু?
হুঁ।
অনেক পাহাড় আছে, ঝরনা আছে। উহ্ কী মজা হবে!
তোর বকবকানি একটু থামা তো রেখা।
সালমা ধমক দেয়। রাগ হয়। এবং একসময় কাউকে কিছু না বলে চুপচাপ বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে। রুবা ভাবি হয়তো খোঁজাখুঁজি করবে। তারপর গাল দেবে। ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও সংসারের ঝামেলায় বেরোতে পারবে না এবং সালমার সঙ্গেও তার দেখা হবে না।
রুবা ভাবির ওখান থেকে সালমা সোজা বাসায় চলে আসে। প্রচণ্ড দুপুর গাছের মাথায়। লেকের পানি শান্ত। নির্জন রাস্তায় দু-একটা গাড়ি ছুটে যাচ্ছে। আবার সব চুপ। আশপাশের বাড়ির দেয়াল উপচে মাধবীলতা, বোগনভিলার লতা ঝুলে আছে। ঘুম ঘুম লাগে সালমার। ছায়াচ্ছন্ন নীরবতা দেখলেই ওর চোখ জুড়িয়ে আসে। বাগানের কাঠের গেট খোলা। গাড়ি বারান্দায় একটা ড্যাটসান দাঁড়িয়ে আছে। সালমা বুঝল সাব্বির ভাইয়ের বন্ধু এসেছে। রিকশার ভাড়া চুকিয়ে ও ঘরে ঢুকল। হাত-মুখ ধুয়ে খাবার ঘরে এলো। সাকিব আর খেতে বসেছে।
তোর জন্য আমরা অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেছি দিদিভাই।
মা মুখটা গম্ভীর করেই বলল, কোথায় গিয়েছিলে?
বাইরে। সালমা প্লেটে ভাত তুলে নেয়।
তুমি এখন যথেষ্ট বড় হয়েছ লিমা। এভাবে ঘোরাফেরা করা ঠিক নয়।
বড় তো কবেই হয়েছি। সেই দশ বছর আগে।
তুমি জানো তোমার জন্য আমাদের ঘুম নেই। কী তোমার ভবিষ্যৎ, কী তোমার পরিণতি কিছুই বুঝতে পারছি না আমরা।
তুমি এখন ধীরেসুস্থে ভাত খাও তো মা।
সালমা একটুও না রেগে কথা বলে। সরষে বাটা দিয়ে ইলিশ মাছ বেঁধেছে আনুর মা। চমৎকার লাগে। ও জানে এ বাড়িতে ওর প্রিয় খাবারগুলো বেশি রান্না হয়। মার নির্দেশ। মাছের কাঁটা বাছায় বেশি। মনোযোগী হবার দরুন সালমা প্লেটের দিকে তাকিয়ে থাকে। মার চোখের দিকে তাকায় না। বুঝতে পারে মা একটুক্ষণ খাওয়া বন্ধ করে হয়তো কিছু ভাবছে। দীর্ঘশ্বাসের শব্দ পায় ও। তারপর মার হাত আবার চলতে থাকে। কথা বলে না।
জানিস দিদিভাই, বাবা না যাবার সময়ে বলেছে তোর দিকে বেশি করে খেয়াল রাখতে। তোর জন্য বাবার চোখে পানি ছিল।
তুই থাম তো সাকিব। এসব ও সুঝলে কোনো দুঃখই তো ছিল না।
মা ফোঁস করে ওঠে। সালমা চুপ করেই থাকে। কোনো মন্তব্য করে না। মা ওর প্লেটে আরো দু’টুকরো মাছ উঠিয়ে দেয়। সালমা আপত্তি না জানিয়ে খায়। ও আজ খুব আস্তে আস্তে খায়। মার খাওয়া হলে মা উঠে চলে যায়। সাকিব একটুক্ষণ উসখুস করে আবার বলে, বাবার জন্য তোর মন খারাপ লাগছে না দিদিভাই?
মন খারাপ আবার কিসের?
আমার খুব খারাপ লাগছে। বাবা তোকে যা আদর করে তার এক কণাও যদি আমাকে করত…
সাকিব মুখ নিচু করে। আর কিছু বলতে পারে না। সালমা ভাবল, বাবার কান্নায় সাকিব আজ বিচলিত হয়ে গেছে। বাবা-মার অতিরিক্ত আদর ওকে নষ্ট করছে। ও নিজের করে কিছু ভাবতে পারে না। নরম নরম চেহারা বলে সবাই ভাবে, ও এখনো বুঝি সেই কিশোরই রয়ে গেছে। ওর আচরণের বেশিরভাগটাই কেমন যেন মেয়েলি। ঋজু বলিষ্ঠ দীপ্ত পুরুষের ছায়া খুঁজে ফেরে সালমা। সাকিবের মধ্যে তার এক কণাও নেই। ও হয়তো কোনোদিনই সে ধরনের পুরুষ হবে না, যে পুরুষত্বের দীপ্তি চমকিত না করে, স্থির করে। সেই টেলিফোনের কণ্ঠ শুনে সালমা তেমনি পৌরুষের আঁচ পেয়েছিল। কিন্তু সামনাসামনি আর দেখা হলো না। সাকিব মুখ নিচু করেই ফিরনি খেল। সালমার দিকে তাকাল না। সালমাও কিছু না বলে উঠে এলো।
মুখে এলাচ নিয়ে বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে থাকল সালমা। শুয়ে শুয়ে একগাদা পত্রিকার ওপর চোখ বুলাল। একটা বই টেনে কয়েক পৃষ্ঠা পড়ল। কিন্তু খুব মনোযোগ দিতে পারল না। মনটা উড়ু উড় করছে। সেজন্য কোথাও স্থিরচিত্ত হতে ভালো লাগে না। মনটা অন্য কোথাও অন্য কিছু খুঁজে ফেরে। অনেকদিন ধরে সেই প্রজাপতিটা আর আসে না। সাদা ফকফকে দেয়াল নিরাভরণ নারীর মুখের মতো দেখায়। অনেকদিন রকিব আর আসে না। একবার খোঁজও নেয়নি। টেলিফোনও করেনি। জোর করে হাসল সালমা। মাস দুই যাবৎ ও কোনো ড্রাগস খায়নি। নেশা ওকে কাবু করতে পারেনি। সেই মামদো ভূত ও অতিক্রম করতে পেরেছে। সেই টেলিফোনের বন্ধু টেলিফোন করেনি। আর কোনোদিন করবে কি না ও তা জানে না। সবকিছু মিলিয়ে ভাবতে সালমার বেশ মজা লাগল। ক্রমাগত ও সেই নির্জন দ্বীপের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। আর তখনই বুনো আদিম উল্লাস সালমার প্রতি স্নায়ুতে আবাল খেলায় মেতে উঠল।
আপামণি।
কী জলিল ভাই?
দেখবে আস।
কী?
আস না।
সালমা জলিল মিয়ার পিছু পিছু বাড়ির পেছনের বাগানে এলো। অনেকদিন এদিকটায় আসা হয়নি। কেমন একটা সোঁদা গন্ধ সালমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়াল। ও চারদিকে তাকাল। হ্যাঁ ঠিকই, ঘাস থেকে আরম্ভ করে গাছের পাতা সবকিছু নতুন নতুন লাগছে। প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিল ও। মনে হলো নতুন বাতাস। সতেজ, ফুরফুরে, আনকোরা। জলিল মিয়া খরগোশের বাক্সটার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়।
এই দেখো।
উফ বাচ্চা হয়েছে? কবে হলো, আমাকে এতদিন বলেনি কেন?
সালমা বাক্সের ভেতর হাত ঢুকিয়ে ছোট ছোট বাচ্চা দুটো কোলে নিল। কী তুলতুলে শরীর! এত নরম কোনো জীবন্ত জিনিস ও আগে কখনো ছুঁয়ে দেখেনি। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নেড়েচেড়ে দেখে। ওর আর আশ মেটে না।