জলিল মিয়া বেলি ফুলের ঝাড় নিয়ে ব্যস্ত। সারা বাগানে সুন্দর গন্ধ ম ম করছে। গাছভর্তি ফুল ফুটেছে। আজ জলিল মিয়া সালমার দিকে মুখ তুলে চাইল না। করতোয়া পাড়ের ছেলে লাজুক হয়ে গেছে। সালমাও ওর সঙ্গে কথা না বলে বেলি ফুল তুলতে থাকে।
এত ফুল তুলছ কেন আপামণি?
মালা গাঁথব।
কার জন্য?
জলিল মিয়া হেসে ফেলে।
কেন নিজের জন্য? আমার খোঁপায় পরব।
অ। তাই বলো। আমি ভাবলাম আপামণি বুঝি এবার আমাদের মিষ্টিমুখ করাবে।
হুঁ, তুমি আমাকে মিষ্টিমুখ করাও না জলিল ভাই।
আমার কি আর নতুন খবর আছে আপামণি।
আছে আছে। অনেক আছে।
কথাটা বলেই সালমা লজ্জা পেল।
কী যে বলো তুমি।
জলিল মিয়া বেলির ঝাড়ের ওপর নুয়ে পড়ল যেন। সালমা কথা না। বলে ফুলগুলো নিয়ে ঘরে ফিরে এলো। সারা বিকেল বসে বসে মালা গাঁথল।
রাতে খাবার পর বাবা ডাকল ওকে।
মাসখানেকের জন্য আমি বাইরে যাচ্ছি লিমা!
শুনেছি।
ভালোভাবে থেকো। লেখাপড়া করো মন দিয়ে।
সালমা চেয়ার ধরে দাঁড়িয়ে থাকে।
বসো না।
আর কিছু বলবে?
না, ঠিক কিছু বলার নেই। তুমি কাছে থাকলে আমার ভালো লাগে।
বাবা আমতা আমতা করে বলে। যেন খুব সংকোচের সঙ্গে, খুব দীনভাবে কথাগুলো বলছে। সালমার কাছে তার অনেক অপরাধ জমা হয়ে আছে। সেই করুণ চেহারার দিকে তাকিয়ে রাগ হলো সালমার। তবু কণ্ঠস্বর যথাসম্ভব কোমল করে বলল, আমি যাই।
সালমা বেরিয়ে এলো। বাবা ডাকল না। মা ও সাকিবও কিছু বলল। সালমার সঙ্গে প্রাণ খুলে কথা বলার মনও ওদের হারিয়ে গেছে। ওকে জোর করে কাছে বসাবার সাহস আর নেই। ওদের নির্বাক পুতুলের মতো বসে থাকার ভঙ্গি অসহ্য। নিজের মেয়ের শ্রদ্ধা যে অর্জন করতে পারেনি সে যাচ্ছে পাণ্ডিত্যের ঝুলি নিয়ে জ্ঞান বিতরণ করতে।
০৬. সালমা ফ্লোরেসেন্ট বাল্বটা নিভিয়ে দিল
ঘরে ফিরে সালমা ফ্লোরেসেন্ট বাল্বটা নিভিয়ে দিল। টেবিল বাতি জ্বালাল। মর্গানের এনসিয়েন্ট সোসাইটি বইটি নিয়ে বসল। নৃতত্ত্ব ওর। পাঠ্য বিষয় নয়। তবু নৃতত্ত্বের বই পড়তে ওর ভালো লাগে। আদিম মানুষের জীবনধারার মধ্যে ও অকৃত্রিম গন্ধ খুঁজে পায়।
সালমার মনে হয় সভ্যতার দ্রুত উত্থানে মানুষ পেয়েছে অনেক, কিন্তু হারিয়েছেও কম না। ওই জীবনেরও একটা বুনো গন্ধ ছিল। পলিনেশিয়ানরা খুব করে সালমার মন টানে। ওই রকম একটা জীবনের স্বাদ ও যদি পেত? সেই বিখ্যাত লাইনটা ঘুরে ফিরে মনে পড়ে। They know no other God but love. ভালোবাসা ছাড়া ওরা কোনো দেবতাকে চেনে না। এ ভালোবাসা ওদের প্রকৃতির মতো মুক্ত, উদার। সবুজ জীবন আমন্ত্রণ জানায়। কেমন বন্ধনে আবদ্ধ করে। গলা চেপে ধরে না।
পড়তে পড়তে সালমার মাথা নিস্তেজ হয়ে আসে। জানালার বাইরে কী যেন একটা পোকা একটানা ঝিঁঝি করে ডেকে চলেছে। ওর মনে হয় কোনো এক আদিম অরণ্য থেকে ভেসে আসছে দ্রিম দ্রিম ঢোলের শব্দ। হাঁড়িয়া খাওয়া মাতাল মেয়ে-পুরুষ নাচছে। নাচতে নাচতে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে যাচ্ছে। দুচোখের পাতায় তখন রাতের আকাশের তারার ফুলঝুরি নেমে আসে। গাছের পাতা একটাও নড়ে না। যদি ওদের ঘুম ভেঙে যায়।
সালমা টেবিলের ওপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ে। স্বপ্ন দেখে ও যেন এক বিশাল অরণ্যের মধ্য দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। পরনে পাখির পালকের রঙিন পোশাক। হাতে তীর-ধনুক। সালমা যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। পথ আর ফুরোয় না। লতানো গাছ নুয়ে পড়ে গায়ের ওপর। বুনো পাখি ডাকে গাছের আগায়। চারদিকে সূর্য-ঝলমল বনানী। সালমার মনে হয় এমন একটা অপূর্ব পৃথিবীর কামনাই ও করছিল। ও সেই পৃথিবীর একটি মেয়ে হয়ে গেছে। ওর চারপাশে ভালোবাসার দেবতারা গান গাইছে। ঐশ্বর্যময় সেই ভালোবাসায় গা ড়ুবিয়ে ও হাঁটছে। আর কিছুই বুঝতে পারে না।
সকালে সাকিবের ডাকাডাকিতে ঘুম ভাঙে। ও জানালা দিয়ে কথা বলে।
অ্যাই দিদিভাই।
কিছু বলবি?
আমরা এয়ারপোর্ট যাচ্ছি।
ভালো।
বাবা তোকে অবশ্য জাগাতে নিষেধ করেছিল, তবু আমি না জাগিয়ে পারলাম না।
সালমা কথা না বলে পাশ ফিরে শোয়। মনে মনে ভাবল, বেলা তাহলে অনেক হয়েছে। একটু পর বাবা নীল আকাশে উড়াল দেবে। প্লেন থেকে পেঁজা পেঁজা তুলোর মতো মেঘ অদ্ভুত দেখায়। পুবের। জানালা দিয়ে একফালি রোদ আসছে। এক টুকরো সোনালি নদী যেন। অসংখ্য ধুলো কণা ভেসে বেড়াচ্ছে সে রোদের গায়ে।
সালমা ভাবল ওই ধুলোকণার সুন্দর বাংলা নাম আছে। ত্রসরেণু। চমৎকার। শুয়ে শুয়ে রোদ আর ধুলোর কণা দেখল ও। আস্তে আস্তে রোদের সোনালি নদী সরে গেল। সালমা উঠল। হাত-মুখ ধুয়ে নাশতা খেল। আনুর মা রাঁধছে। জলিল মিয়া বাগানে।
সালমা শাড়ি পাল্টে রাস্তায় নামল। অনেক দিন রুবা বাবির বাসায় যাওয়া হয়নি। লেকের পাড় পর্যন্ত ও ধীরেসুস্থে হেঁটে এলো।
তোর কথাই ভাবছিলাম সালমা।
কী ব্যাপার বলো তো? কেমন গোছগাছ চলছে দেখছি।
তোর ভাই সিলেটে বদলি হয়েছে সালমা। সামনের সোমবার। আমরা রওনা করছি।
তাই নাকি? সালমা কেমন নিঃসঙ্গ বোধ করল।
তোকে আজ সারাদিন আমার সঙ্গে থাকতে হবে সালমা।
না, আজ থাকতে পারব না।
উঁহু, কোনো ওজর-আপত্তি শুনছি না। চলে তো যাচ্ছি। আবার কখন দেখা হবে কে জানে।
দেখা হবারই বা দরকার কী? সারাজীবন ধরে দেখাশোনা হতেই হবে এমন কোনো কথা নেই।
শোনো মেয়ের কথা। তোর মতো বেশি আমি বুঝি না সালমা। তবে লোকের সঙ্গে জড়িয়ে জড়িয়ে না থাকলে আমার ভালো লাগে না।