সালমা ভাবল, এ বাড়িতে আরো দুজন লোক থাকে, তারা গেল কই? জলিল মিয়া, আনুর মা বৃষ্টি মাথায় করে বেরোলো নাকি? রান্নাঘরের পাশের ঘরটায় জলিল মিয়া থাকে। আনুর মার জায়গা হয়েছে স্টোররুমে। জলিল মিয়ার ঘরের দিকে এগোলো সালমা। জলিল মিয়াকে ডেকে নিয়ে এসে করতোয়া পাড়ের গল্প শুনবে এখন। ভরা বর্ষায় যৌবনবতী করতোয়া নাকি অনন্যা হয়।
কিন্তু ঘরের কাছে এসে থমকে গেল সালমা। ফিসফিসানি শব্দ ভেসে আসছে গোপনে। তবে কি? সন্দেহটা মনের মধ্যে খেলে গেল। পরক্ষণে হাসল, যদি তাই হয় মন্দ কী? আনুর মা জলিল মিয়া দুজনের বুকেই এখন করতোয়ার উন্মাতাল ঢেউ।
অ্যাই ছাড় না। ছিহ।
কী যে খালি না না করো।
সালমা আর দাঁড়াল না। ফিরে এলো। করতোয়া পাড়ের গল্প শোনা হলো না। সারা বাড়ি একটা নদীর মতো মনে হলো ওর। সেই নদীর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সময়ের কাছে নতজানু হয়েছে ওরা। আরো আগে হওয়া উচিত ছিল। না, এ নিয়ে সালমার মনে কোনো গ্লানি নেই। ও বরং খুশি হলো। ওর মনে হলো সময়ের ঘড়িটা আরো একটু দেরিতে বাজুক। ওরা আরো সময় পাক। সময় পাক নিবিড় হবার–মাতাল হবার–ভোগ করবার। দুজনেই অনেক কষ্টের নদী পেরিয়েছে। অনেক ঘাট গড়িয়েছে। অনেক দীর্ঘ সময় পবিত্র রেখেছে। এখন কি আর সেইসব অপচয়ের দিনগুলোকে সুদে-আসলে ওঠানো যাবে? দরকার কী? যা হারিয়েছে তা হারাক। সামনের দিনগুলো ওদের পায়ে গোলাপ ছড়াক।
সালমা নিজের ঘরে এলো। টেবিলে ওপর রকিবের চিঠিটা এখনো পড়ে আছে। গতকাল ডাকে চিঠিটা এসেছে। আট পৃষ্ঠা চিঠি লিখেছে রকিব। পড়তে পড়তে হাই উঠেছে ওর। বিরক্তি লেগেছে। শেষ করতে পারেনি। ইনিয়ে-বিনিয়ে এত কথা যে মানুষের লেখার থাকে, সালমার জানা ছিল না। সালমা কোনোদিন কাউকে চিঠি লেখেনি। কেমন আছেন, ভালো আছি জাতীয় দুলাইন চিঠিও না। রকিব জানতে চেয়েছে সালমার শেষ কথা কী। সালমার হাসি পেল। কারো জীবনে কোনো শেষ কথা থাকতে পারে নাকি? নতুন নতুন কথা সৃষ্টি করতে না পারলে তো সে জীবন অর্থহীন, ক্লান্তিকর। সালমার জীবনে কোনো শেষ কথা নেই। রকিব একটা পাগল। তাই পাগলের মতো প্রলাপ বকেছে। যতসব ভাবনা। সালমা চিঠিটা টুকরো টুকরো করে ছিড়ে বাইরে ফেলে দেয়।
সাতদিন পর রকিব এসে হাজির। মুখটা গম্ভীর, রুক্ষ। ওর ভেতরে একটা ভীষণ ওলটপালট চলছে। চুলের ভেতর হাত ড়ুবিয়ে মাথাটা নিচু করে বসে থাকে। আজ আর ওর ঘরে আসে না। ড্রয়িংরুমে বসে। সালমা অনেকক্ষণ বসে থাকার পরও রাকব কিছু বলে না।
আমি কি উঠে চলে যাব রকিব? সালমা রাগতস্বরে জিজ্ঞেস করে।
তুই আমার চিঠি পেয়েছিস?
পেয়েছি।
জবাব দিলি না যে?
তার কি কোনো দরকার আছে?
আমার আছে।
আমি জবাব দিতে বাধ্য নই। তাছাড়া উত্তর দেবার মতো কোনো কথাও আমার নেই।
সালমা?
আমি কোনো কথা রেখেঢেকে বলি না রকিব।
তোর ইচ্ছেটা কী বল তো?
আমার ইচ্ছে? আমার অফুরন্ত ইচ্ছের শেষ আছে নাকি।
সালমা শব্দ করে হাসে। রকিবের মুখটা কালো হয়ে যায়।
তুই ভালোবাসা চাস না সালমা?
কখনো কখনো চাই। সবসময় না। তাছাড়া ভালোবাসার অধিকার আমার সহ্য হয় না। অধিকার যখন জোর করে দাবি প্রতিষ্ঠিত করতে চায় তখন আমার মরতে ইচ্ছে করে।
এর পরিণাম কী?
পরিণাম জানি না।
তোর জন্য আমার কষ্ট হচ্ছে।
তোর জন্য আমারও রকিব।
তুই আমাকে বুঝতে চাইলি না।
তোকে বুঝি বলেই ফাঁকি দিতে চাই না।
তোর জন্য আমি অপেক্ষা করব।
হেঁদো কথা ছাড়। ন্যাকা পুরুষ আমার পছন্দ না।
সালমা।
রকিবের কণ্ঠে আর্তনাদ বয়ে যায়।
তোর কাছে কি হৃদয়ের কোনো মূল্য নেই সালমা?
আছে। প্রয়োজন হলে তোকে আমি ডাকব।
ডাকিস।
রকিব উঠে দাঁড়াল। বারান্দা দিয়ে হাঁটল। সিঁড়ি দিয়ে নামল। লন পেরোলো। গেট খুলল। চলে গেল।
সালমা বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখল। বুকের মধ্যে কট করে একটা শব্দ হলো। বাম দিকটা ব্যথা করছে যেন। রকিব ওকে ডাকিস বলে চলে গেল কেন? বললেই পারত ও ডাকলেও আর কোনোদিন রকিবের সময় হবে না। ডাক দিলেই কি আসা যায়? বোধহয় আসা যায়। নইলে গালিব অমন কথা লিখবেই বা কেন? গালিবের মতো মহান কবি তো আর মিথ্যে লিখতে পারে না—
অনুকম্পা হলে ডেকে নিও আমায়
যে-কোনো সময়ে;
আমি তো অতীতকাল নই যে
ফিরে আসতেই পারব না।
পেছন ঘুরতেই মার মুখখামুখি হয়ে গেল।
কিরে রকিব অমন করে চলে গেল যে। কী বলেছিস তুই?
বললাম, আর যেন এখানে না আসে।
সালমা হালকা গলায় কথা বলে।
তোর কপালে যে কী আছে? ছোঁউ করে শ্বাস ফেলে। তোর জন্য একটা মজার খাবার তৈরি করেছি। চল।
চলো।
নিজেকে পাখির পালকের মতো হালকা করে দিতে চাইল সালমা। মার পিছু পিছু খাবার ঘরে এলো। আনুর মার দিকে একটু অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। আনুর মার মুখটা যেন ঝলমল করছে। কালো চামড়ার ওপর দিয়ে কী একটা অদৃশ্য ঝলক ভেসে বেড়াচ্ছে।
কী রে হাঁ করে ওকে কী দেখছিস?
সালমা লজ্জা পেল। তাড়াতাড়ি চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলল, আনুর মার স্বাস্থ্যটা একটু ভালো হয়েছে।
আনুর মা টেবিল মুছে চলে গেল। সালমা অনেকক্ষণ ধরে পিঠে খেল। মা তিন-চার রকম পিঠে বানিয়েছে আজ।
তোর বাবা কাল আমেরিকা যাচ্ছে। তুই যাচ্ছিস তো এয়ারপোর্ট?
ক’টায় প্লেন?
সকাল সাড়ে দশটায়।
আমার কাজ আছে। তোমরা যাও।
আমরা তো যাবই। সে কি আর তোকে বলতে হবে?
মা রেগে কথা বলে। সালমা আর কোনো কথা বলার উৎসাহ পায়। কথা বলা বৃথা। পেটপুরে খেয়েদেয়ে উঠে পড়ে। বারান্দা পেরোনোর সময় দেখল, ড্রইংরুমে সাকিব আর মিতালি কথা বলছে। ওদের দেখলে ওর সাদা খরগোশ জোড়ার কথা মনে পড়ে সালমার। ওরা মনের মধ্যে অমনি একটা কাঠের বাক্স বানিয়ে দিন-রাত ওর ভেতর ড়ুবে থাকে। সারাদিন খেলা করে। কখনো মান-অভিমান, কখনো ঝগড়া। আবার সব ঠিক। একটুও ক্লান্তি নেই ওদের। ওরা নিজেদের মধ্যেই মশগুল। মা পিঠে আর চা পাঠিয়েছে। মিতালিকে বাড়ির সবাই খুব পছন্দ করে। বাবাও কখনো ওকে ডেকে বসায়। বসে কথা বলে। সালমার মনে হয়, ওর অভাবটা কি ওরা মিতালির মধ্যে খুঁজে ফেরে? ও যা দিতে পারেনি মিতালি তা পারে? তাই ওর এত আদর? সত্যি ভালো মেয়ে মিতালি। ওরা কেউ সালমাকে দেখতে পেল না। ও ধীরেসুস্থে বাগানে নেমে এলো।