ঘরে পানি আসছে আপা!
বুড়ি ঝির খনখনে গা। সালমা ধমকে উঠল ওকে।
তাতে তোমার কী?
সোফা ভিজে গেলে বেগম সাহেব বকবে।
সে আমি বুঝব, তুমি যাও এখান থেকে।
সালমার রূঢ় কণ্ঠে বুড়ি ঝি ফিরে গেল। বুড়ি বিড়বিড়িয়ে কী যেন বলল। হঠাৎ সালমার মনে হলো ওর ওপর ও অকারণে রাগ করেছে। কোনো মানে হয় না এ রাগের। লজ্জা হলো মনে মনে। তবু হাতের পাশে টিপয়ের ওপর রাখা নাসিমার সাজানো ফ্লাওয়ার ভাস এলোমেলো করে ফেলল। লাল গোলাপের পাপড়ি টুকরো টুকরো করে উড়িয়ে দিলো বাতাসে। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে সেগুলো গিয়ে পড়ল নিচে ঘাসের ওপর। একে একে তিনটে গোলাপের পাপড়ি ও বাতাসে ওড়াল। জানালায় ঝুঁকে পড়ে তাকিয়ে থাকল অনেকক্ষণ। তবু ঘরের দরজা। খুলল না। সালমার অস্থির লাগছে। ইচ্ছে হলো দরজার গায়ে দড়াম দড়াম লাথি মারতে। কিন্তু হাত কামড়ানো ছাড়া সালমা আর কিছু করতে পারল না।
তখুনি ঘরের আরেক পাশে চুপচাপ শুয়ে থাকা টেলিফোনটা শব্দ করে উঠল। সালমার বুকটা ধড়াস করে ওঠে। ভীষণ আকাঙক্ষায় দৌড়ে গিয়ে টেলিফোনটা ওঠায়।
হ্যালো?
হ্যালো, সাব্বির খান আছেন?
সরি, রং নাম্বার।
সালমা নিঃশব্দে টেলিফোনটা যথাস্থানে রেখে দিল। যেন ও কোনো মৃত মানুষকে কবরে নামিয়ে রাখল। যেন ও কারো শান্তি বিঘ্নিত করতে চাইল না। ও ভুলেই গিয়েছিল, এটা ওর বাড়ি নয়। এখানে সাব্বির খান থাকে। কিন্তু ও এখন সাব্বির খানকে ডাকবে কেমন করে? কেমন করে বলবে। টেলিফোনটা আবার বাজল।
হ্যালো, সাব্বির খান আছেন?
সালমা কথা না বলে রেখে দিলো।
টেলিফোন আবার বাজল। 9
দেখুন, আমি ভুল করছি না। এটাই সাব্বিরের নাম্বার। আমি ওর বন্ধু আতোয়ার। ওর সঙ্গে আমার ভীষণ জরুরি দরকার। বিজনেস পারপাস। প্লিজ, আপনি ওকে ডেকে দিন। ওকি বাসায় নেই? হ্যালো হ্যালো হ্যালো–
সালমা টেলিফোন কানে লাগিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। কথা বলল। ওপাশ থেকে বিরক্তিসূচক শব্দ পাওয়া গেল। সালমা তব। রিসিভারটা কানে লাগিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। বিড়বিড় করল, বিজনেস পারপাসের চাইতেও ভীষণ জরুরি কাজে এখন সাব্বির খান ব্যস্ত। টেলিফোনটা নামিয়ে রাখার সঙ্গে সঙ্গে ওটা আবার বাজল।
হ্যালো? সালমা এবার সাড়া দিলো।
সাব্বির খান কি নেই? রূঢ় কণ্ঠ।
আছে।
কোথায়?
লাল পর্দার ওপারে।
লাল পর্দার ওপারে? কী বলছেন আপনি?
ঠিকই বলেছি।
নাসিমা কোথায়?
উনিও ওখানে।
কী করছে ওরা?
এবার সালমার ভীষণ হাসি পেল। কী বোকা লোকটা, কেমন অবলীলায় শুনতে চাইছে।
হ্যালো হাসছেন কেন? অধৈর্য কণ্ঠ। বলবেন তো কী করছে ওরা?
সে কথা কি বলা যায়?
লে বাবা, কিছুই বুঝতে পারছি না। আচ্ছা শুনুন, লাল পর্দার ওপারে আর কী আছে? আছে বার্মা টিকের খাট, ফোমের গদি, সার্টিনে মোড়া বালিশ, নাইলন নেটের মশারি—
মাথামুণ্ড কিছু বুঝতে পারছি না। আপনি জানেন না, আজকে কাজ করতে পারলে সাব্বিরের অনেক টাকা লোকসান হয়ে যাবে।
কাজ না করলে লোকসান হয়, তা তো জানা কথা।
ধুৎ। আমি আসছি।
ওপাশে টেলিফোন ছেড়ে দেয়। রিসিভার রেখে দিয়ে সালমা চিন্ত য় পড়ে গেল। লোকটা আসছে। কতক্ষণ লাগবে আসতে? দশপনেরো-বিশ মিনিট? না আরো কম? নাকি বেশি? না ভীষণ জরুরি কাজ বলেই লোকটা ছুটতে ছুটতে আসবে। তাঁর আগে চলে যাওয়া ভালো। জানালা দিয়ে বাতাস আসছে। লালপর্দা দুলছে। বুড়ি ঝিকে জানালা বন্ধ করতে বলে সালমা তরতরিয়ে নেমে যায়। আর তখনই ওদের। কাঠের গেটের সামনে এসে থামে একটা ধানি রঙের ড্যাটসান। বারান্দায় সাকিবের সঙ্গে দেখা হয়ে যায় সালমার
তোর মুখ-চোখ অমন লাল দেখাচ্ছে কেন দিদিভাই। কী হয়েছে?
সালমা জবাব দিলো না। মনে মনে ভাবল, ভাগ্যিস ওই লোকটা ওকে দেখেনি। তবে সাব্বিরের কাছে গল্প করলে ওরা ঠিকই বুঝতে পারবে যে কার কাণ্ড। সাকিব পিছে পিছে ঘরে ঢোকে।
তুই দোতলায় গিয়েছিলি দিদিভাই?
হ্যাঁ।
বাব্বা, তোর কত সাহস। বাবা জানলে–
জানলে কী হবে? আমি তো সবসময় যাই।
সালমা হাত উল্টে মুখভঙ্গি করে। সাকিব ওকে আর না ঘাঁটিয়ে অন্য প্রসঙ্গে চলে যায়। জানিস দিদিভাই, মিতালি না ফিরে এসেছে?
খুব ভালো কথা। ঝগড়াঝাটি মিটমাট হয়েছে তো?
হ্যাঁ। সাকিব লাজুক হাসে।
ঝগড়াঝাঁটি বড় বাজে জিনিস, না দিদিভাই?
খুব বাজে। আর কখনো ঝগড়া করিস না।
আমি করি নাকি ও মাঝে মাঝে কেমন যেন করে!
সালমা হাসে।
বাবা-মা কী করছে সাকিব?
বাবা বেরিয়েছে। মা ঘুমুচ্ছে।
বেশ কথা। বৃষ্টি-পড়া দুপুরে ঘুমুতে মন্দ লাগে না।
সামনের সোমবার বাবা আমেরিকা যাচ্ছে।
ও।
প্লেনের টিকিট এসে গেছে।
ও।
বাবার যাওয়াতে আমার খুব খুশি লাগছে। মা-ও খুব খুশি।
হবেই তো। আমেরিকা থেকে বাবা কিছু জিনিসপত্র আনবে। মা এগুলোর জন্য খুশি।
আমার ঘুম পাচ্ছে দিদিভাই। যাই।
সাকিব জানে সালমা হয়তো আর কিছু বলে ফেলবে। এজন্য তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যায়। সাকিবের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে সালমা মনে মনে হাসে। সাকিবের সঙ্গে ও আপস করেছে। কেননা সাকিব অনেক কিছুই না জেনে করে। আর ওর এই না জেনে করার ভঙ্গিটা সালমার প্রিয়। এজন্য ও সরল সহজ এবং পরিষ্কার জলের মতো টলটল করে। ওই পানিতে হাত ডোবাতে একটুও অসুবিধা হয় না সালমার।
কিন্তু এখন সালমা কী করবে? ওর তো ঘুম পাচ্ছে না। টিপটিপিয়ে বৃষ্টি পড়ছেই। মার ঘরের দরজা বন্ধ। সাকিবও দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। সালমা চেয়ার নিয়ে বারান্দায় এসে বসে। ধানি রঙের ড্যাটসান চলে গেছে। সালমার মনে হয় ও একা এই নির্জন বাড়িটার রাজকন্যে। রাক্ষস এসে মায়ার কাঠি দিয়ে সকলকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে। কেউ কোথাও জেগে নেই। পরিচিত এই বাড়িটা অপরিচিত মনে হয় ওর। গোলকধাধার মতো লাগে। এ বাড়িতে এসে সালমা ওর পথ হারিয়েছে। কামিনী ফুল গাছটার চিকন ডালে একটা লাল-বুক টিয়া বসে বসে বৃষ্টিতে ভিজছে। হঠাৎ হঠাৎ অনেক সুন্দর পাখি এ বাগানটায় আসে। একটু ক্ষণের জন্য দেখা দিয়ে কোথায় উড়ে চলে যায়। আর কোনোদিন আসে না। সালমা বারান্দার এ-মাথা ও-মাথা পায়চারি করে।