কী বললি?
তোকে আমি আর চাই না।
সালমা?
সোজা সরল স্পষ্ট কথা বলছি।
কিন্তু তোকে আমার চাই। আমি তোকে ভালোবাসি।
ভালোবাসা? হেসে গড়িয়ে পড়ে সালমা। তোর ভালোবাসা তো আবাল খেলার জন্য।
সালমা।
সালমা দু’পা এগিয়ে আসে। সালমা হাসতেই থাকে। হাসি আর থামে না। হাসির দমকে ওর শরীর কাঁপে। থিরথির শান্ত জলের বুকে মৃদু স্রোতের মতো।
সত্যি বলছি রকিব, এখনই আসল সময়। আমাদের আর এগোনোর দরকার নেই। এগোতে গেলেই তিক্ততার সৃষ্টি হবে। আমি চাই না তোর সঙ্গে ঝগড়া করতে।
রকিব সালমার কাঁধ চেপে ধরে। সাঁড়াশির মতো হাত। ঘাড়ে ব্যথা লাগে।
একটু থমকে যায় সালমা। রকিব ওর চোখে চোখ রাখে। ঝুঁকে পড়ে মুখের ওপর।
আমি কোনো কথা শুনতে চাই না। আমি শুধু তোকে চাই। তোর এই নরম মোমের মতো দেহ আমার আবাল খেলার জন্য অবশ্যই দরকার। আমার ভালোবাসা সব মিলিয়ে। বায়বীয় ভালোবাসা আমি বিশ্বাস করি না সালমা।
রকিব সালমার গালে গাল ঘষে। হাত দুটো পিঠের ওপর নেমে আসে। বাঁধন আরো গাঢ় হয়। সালমার অস্তিত্ব নষ্ট করে দিয়ে রকিব সেটা তার আপন দেহে মিশিয়ে নিতে চায়। সালমা এখন অসম্ভব শান্ত। শরীরের ভার ছেড়ে দেয়। রকিব ওকে পাঁজাকোলে করে বিছানায় শুইয়ে দেয়।
অবিন্যস্ত শাড়ি ঠিক করে। বুকের ওপর আঁচল টেনে দেয়। হঠাৎ করে সালমার ওপর অসম্ভব মায়া হয় ওর। মনে হয় সালমার কেউ নেই। ও ভীষণ একা, ভীষণ নিঃসঙ্গ। এদিকে সালমার ভেতর তখন ফুলে ফুলে ওঠে। চোখের কোণ বেয়ে জলের রেখা নামে।
সালমা তুই কাঁদছিস? তোহাই লাগে কাঁদিস না।
রকিব ওর ভিজে চোখে চুমু খায়। সব শুষে নিতে চায়। এই মুহূর্তে মনে হয় সালমার জন্য ও সব করতে পারে। ও বড় দুঃখী মেয়ে। দুঃখটা ওর নাড়ির পরতে পরতে।
সালমা লক্ষ্মী সোনা বল, তোর জন্য আমি কী করব?
ও কথা বলে না। অস্থির আবেগ রকিবকে কাঁপিয়ে দেয়। সালমার আঁচল দিয়ে চোখ মোছায়। নরম ঠোঁটে হাত রাখে। গালে মৃদু আঙুল ঘষে।
সালমা তোর কী চাই বল? তুই যা বলবি আমি তাই করব। বল সালমা বল।
রকিব ভীষণ কিছু প্রত্যাশা করে। প্রত্যাশা করে নতুন আমন্ত্রণ। সালমার শান্ত মুখে রঙধনু হাসি। মেঘের পরে মেঘ ছাড়িয়ে নীল আকাশে বিহার। সালমা ওকে সঙ্গী করে পথে নামবে। সালমা আস্তে কথা বলে।
রকিব।
বল।
আমি চাই তুই এখন চলে যা।
বেশ।
রকিব উঠে দাঁড়ায়। কোনোদিকে না তাকিয়ে চলে যায়। বাগানের কাঠের গেটটা অসম্ভব শীতল মনে হয়। যে বাড়িটা ও ছেড়ে যাচ্ছে সে বাড়িটাও যে মোমের মতো মেয়েটিকে ও ছেড়ে এলো সে যেন মমি হয়ে যাচ্ছে। এখন আর কোনো আকাশ নেই। জীবন নেই। কোলাহল নেই।
সালমার চোখের কোনায় জলের রেখা দ্রুত গড়ায়। চোখ বুজে শুয়ে থাকে ও। অন্তরে কোনো রকিব নেই। বাইরে সন্ধ্যা গাঢ় হয়। জলিল মিয়া বারান্দায় বাতি জ্বালিয়ে রেখেছে। সালমার ঘরে মিটমিটে আলো। সালমার চোখে জল। ঠোঁটে রকিবের স্পর্শ। গালে রকিবের স্পর্শ। বুকের ওপর রকিবের স্পর্শ।
কিন্তু অন্তরে কোনো রকিব নেই।
যখন তখন হুড়মুড়িয়ে বৃষ্টি নামে। ইউনিভার্সিটি বন্ধ। সালমার কখনো কখনো একঘেয়ে লাগে। কখনো ভালো। আজকাল ফাঁক পেলেই নাসিমার ওখানে উঠে যায়। ড্রাগস মোটামুটি ধাতে সয়ে গেছে। আর কোনো অসুবিধে হয় না। তবে ওতে সালমা অভ্যস্ত হয়নি। সাব্বির হাসে।
তুমি আমাকে অবাক করেছ সালমা!
কেন?
তুমি যে এত শক্ত মেয়ে, বাইরে থেকে তো বোঝা যায় না।
সালমা শব্দ করে হাসে। নাসিমা ফুল সাজাতে সাজাতে উত্তর দেয়, শক্তর কী দেখলে? ও আরো অনেক কিছু পারবে।
এই তো চাই, কী বলো সালমা? আমার ইচ্ছে করে কী জানো যে শ্লোগান দিই, আসুন আমরা যেমন তেমন করে বাঁচি। ছকবাঁধা জীবন আর কত?
নাসিমা ফ্রিজের ওপর ফ্লাওয়ার ভাস রাখতে রাখতে বলে, তোমার মতো সবার চাওয়াটা এক হলে তো হতোই।
সালমা প্রসঙ্গ পাল্টায়।
ঘরে বসে থেকে তুমি কিন্তু মুটিয়ে যাচ্ছ নাসিমা’পা।
তাই নাকি? তাহলে তো বিশ্রী ব্যাপার। তুমি কী বলল সাব্বির? আমাকে কেমন দেখাচ্ছে?
তরতাজা বিড়ালের মতো।
যাহ্।
যাহ্ নয়। সত্যি কথা।
সাব্বির মুখটা গম্ভীর করে রাখে। সালমার হাসি থামে না। নাসিমা ছেলেমানুষের মতো লাফালাফি করে।
অ্যাই তুমি মুখটা অমন করে রেখেছ কেন?
দেখ নাসিমা, আমি একটা জিনিস ভীষণ ভাবছি।
কী?
উঁহু বলব না।
এই তোমার এক দোষ। কথা শুরু করে আবার থামিয়ে দাও। বেশ, আমিও শুনব না। নাসিমা দুপদাপ শোবার ঘরে চলে যায়। সাব্বির হো হো করে হাসে।
ভাগ্যিস চাকরি ছেড়ে দিয়েছে। নইলে এখন যদি ওর ছাত্রছাত্রী সামনে থাকত, তাহলে কেমন হলো সালমা?
না সাব্বির ভাই, আপনি নাসিমা’পাকে বড় খেপিয়ে দেন।
এই নিয়ে তো বেঁচে আছি। এক্ষুণি আমি সব ঠিক করে আসছি।
সাব্বির শোবার ঘরে যায়। এ ঘরে বসেই ওদের হুটোপুটির শব্দ পায় সালমা। সঙ্গে উচ্চ হাসি। পর্দার ফাঁক দিয়ে দেখবার চেষ্টা করে। পারে না। শিরশির করে শরীর। সালমা ভাবল, ওরা কি ভুলে গেছে যে। সালমা এ ঘরে বসে রয়েছে! সালমা বয়স্ক মেয়ে। অথচ ও সীমিত আকাক্ষার মেয়ে নয়। রাগ হলো। ভীষণ রাগে হাত কামড়াল খানিকক্ষণ। বাইরে ঝুপঝুপিয়ে বৃষ্টি পড়ছে। সালমা জানালার কাছে এসে দাঁড়াল। ঘুরেফিরে ওদের কথা মনে হচ্ছে। ওরা এখন তেপান্তরের মাঠে দামাল যুবক-যুবত। ধুৎ! ভাবনাগুলো তাড়াতে চাইল। বাইরে হাত বাড়িয়ে বৃষ্টির ছোঁয়া নিল। একসময়ে অবাক হয়ে দেখল ওদের শোবার ঘরের দরজা বন্ধ। লাল পর্দাটা শান্ত। সালমা বন্ধ দরজার ওপর দৃষ্টি ফেলে পঁড়িয়ে রইল। ছিটেফোঁটা বৃষ্টি এসে পিঠের। দিক ভিজিয়ে দিচ্ছে। খেয়াল নেই।