বিকেলে রকিব এলো।
কীরে, তুই নাকি হারিয়ে গিয়েছিলি?
সত্যি সত্যি হারিয়ে গেলে তো বেঁচে যেতাম।
ইস্, দেখি দেখি তোর চোখগুলো অমন ফুলো ফুলো কেন? কেঁদেছিস নাকি?
এসেই জেরা শুরু করলি কেন? বোস না।
তাই তো।
রকিব একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়ার টেবিলের সামনের চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসে। সালমা খাটের ওপর উঠে বসে। কখন রকিব এসেছে টের পায়নি। টেনেটুনে শাড়ির কুঁচি ঠিক করে। হাত দিয়ে এলো খোঁপা বাঁধে। সারা দুপুর অকারণ কান্নার পর বুকটা এখন হালকা লাগছে। মনে হচ্ছে, ডানা মেলে দিব্যি উড়তে পারবে। রকিব ওকে পরখ করছে। মুখে। কিছু বলছে না। কদিনের মধ্যে ও বেশ বড় গোঁফ রেখেছে। ওকে অন্যরকম দেখাচ্ছে। একটু রুক্ষও যেন। ওর চোখের দৃষ্টি কাঁপছে। সালমা খাট থেকে নেমে বাথরুমে যায়।
তুই বোস রকিব, আমি হাত-মুখ ধুয়ে নিই
সেই ভালো। ওই রকম মুখফোলা হুলো বেড়ালের মতো চেহারা দেখে বিকেলটা মাটি করতে চাই না।
সালমা হেসে বাথরুমের দরজা বন্ধ করে।
হাতে মুখে চোখে জল দিতেই বদলে যায় লুকানো অন্তর। বেসিনের ওপর লাগিয়ে রাখা দেয়াল-আয়নায় নিজেকে অচেনা লাগে সালমার। মনে হয়, এই আমি কোনো আমি নই। ওই রকিব নামক যুবকটিকে আমি চিনি না। আমার শরীরে ওর স্পর্শ নেই। আমার অন্তরে ওর জন্য ভালোবাসা নেই। দূর, ভালোবাসা আবার কী? ভালোবাসা মানে ভিড় জমিয়ে মজা লোটা। চাই না। চাই না। চাই না।
সালমা চেঁচিয়ে উঠতে গিয়ে আবার মুখে হাত চাপা দেয়। জলের স্পর্শ এত মমতাময়ী যে, প্রিয়জনের মতো কানে কানে পথ বাতলে দেয়। জলের ভেতর কী আছে? সালমার ইচ্ছে হচ্ছে শাওয়ার ছেড়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে। খোলা ট্যাপ দিয়ে হড়হড় করে জল পড়ছে। বেসিনের ফুটো বন্ধ করে ছোট একটা পুকুরের মতো করে ফেলে তন্ময়। হয়ে তাকিয়ে থাকে সেদিকে। মনে মনে ভাবে, রকিব আজ না এলেই ভালো করত। এই মুহূর্তে ওকে অসহ্য লাগছে।
কীরে সালমা, বাথরুমে ঘুমিয়ে গেলি নাকি?
রকিব চেঁচিয়ে ডাকে। ও ইচ্ছে করে উত্তর দেয় না। রকিব ডাকুক। ডেকে ডেকে চলে যাক। বউ-কথা-কও পাখির মতো অনন্তকাল ধরে ডেকে ডেকে ফিরুক। সালমা আর কোনোদিন সে ডাকে সাড়া দেবে না।
সালমা, অ্যাই সালমা–
আহ্, তুই আমাকে অমন করে ডাকিস না রকিব। কেউ আমাকে ডাকুক আমি চাই না। বেঁচে থাকার জন্য আমার একটা নিরাপদ পৃথিবী। দরকার। অযথা লোকের ভিড় বাড়িয়ে সে পৃথিবী আমি নোংরা হতে দিতে পারি না রকিব। তুই ফিরে যা। তোর জন্য সালমার কোনো ভালোবাসা নেই।
সালমা কী হলো? কথা বলছিস না কেন?
মিছে ডাকছিস রকিব। তোর এই আবাল খেলার স্বাদ তো তুই আমাকে দিয়েছিস। সত্যি, বড় চমৎকার। কিন্তু এত ক্ষণিকের যে আমি ভুলে যাই সে স্মৃতি। কেন আমার সোনার কৌটায় মানিক হয়ে জ্বলে না রকিব? কেন জোনাকির মতো জ্বলে নিভে যায়?
সালমা লক্ষ্মীসোনা দরজা খোল? আমি বুঝতে পারছি না যে তোর কী হলো?
রকিবের উৎকণ্ঠিত কণ্ঠে হাসি পায় সালমার। বেসিন ভরে জল উপচিয়ে পড়ছে। ভিজে যাচ্ছে শাড়ি। পায়ের পাতা। এমনি করে ওকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় না কেন জলের স্রোত? ভাসতে ভাসতে ও নতুন জাগা দ্বীপে গিয়ে উঠবে। ওখানে দেখবে সব অন্যরকম। মাটি, ঘাস, পাখি, রোদ বর্তমানের চাইতে আলাদা। মাটির রং সাদা ফকফকে, ঘাস হলুদ, রোদ নিবিড় লাল। পাখি একটাও উড়তে জানে না। সে রাজ্য সালমার একলার। বর্ষা বসন্তে হেমন্তে সে দ্বীপের সমস্ত রং যাবে বদলে। এক একটা ঋতু হবে এক একটা রঙের প্রতীক। জলের রং থাকবে সকালে নীলাভ, দুপুরে ধূসর, সন্ধ্যায় বাসন্তি। সমুদ্রের পাড়ে বসে সালমা ঢেউ গুনবে।
সালমা প্লিজ–
রকিবের অস্থির কণ্ঠে অঢেল মিনতি। সালমার মন তার কল্পনার দ্বীপের মতো শান্ত হয়ে গেছে। ও খুট করে দরজা খুলে দেয়।
সালমা কী হয়েছে?
রকিব ওর খুব কাছে এসে দাঁড়ায়।
কই, কিছু না তো।
সালমা জল ছড়ায় দুহাতে।
ট্যাপটা বন্ধ করে দে, সব পানি পড়ে যাচ্ছে।
যাক না। জলের সঙ্গে খেলতে ভালোই লাগে।
রকিব একটু অবাক হয়।
সালমা, তোকে আমার চাই একান্ত আপন করে। নিবিড় করে–
রকিব ওকে পাগলের মতো চুমু খায়। রকিবের উচ্ছ্বাসের কবল থেকে নিজেকে জোর করে ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করে ও। রকিবের গায়ে যেন অসুরের শক্তি।
ঠাস করে চড় পড়ে রকিবের গালে। অপ্রস্তুত হবার সঙ্গে সঙ্গে শিথিল হয়ে যায় রকিবের হাতের বাঁধন। একটু পিছিয়ে আসে। সালমা ট্যাপটা বন্ধ করে দেয়। গোটা শাড়ি ভিজে গেছে ওর। সালমার মনে হয় ওর সারা গায়ে পোকা কিলবিল করছে। এবং ও নিজেই একটা বিরাট পোকা হয়ে গেছে।
ফুল স্পিডে ফ্যান ছেড়ে দিয়ে রকিব ফ্যানের নিচে দাঁড়িয়ে থাকে। ওর প্যান্ট-শার্ট অনেকখানি ভিজে গেছে। সালমার ভিজে শরীরে আশ্চর্য মাদকতা। ভিজে শাড়িতে সপসপ আওয়াজ তুলে সালমা আলনা থেকে একটা শাড়ি নিয়ে যায়। শাড়ি পাল্টে আসার পর ওকে কেমন ফ্যাকাশে দেখায়। ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে ক্রিম ঘষে মুখে। মিটিমিটি হাসে।
তোর কি খুব জোরে লেগেছে রকিব?
রকিব কথা বলে না। মুখটা গম্ভীর। সালমার দিকে পিঠ করে দাঁড়িয়ে আছে ও।
অ্যাই রকিব? র-কি-
ছেলেমানুষি দুষ্টুমিতে পেয়ে বসে ওকে। টেনে টেনে উচ্চারণ করে রকিবের নামটা এবং কখনো ভেঙে ভেঙে। তবু সাড়া দেয় না রকিব।
তুই কি আমার সঙ্গে কথা বলবি না রকিব? না বলাই বোধহয় ভালো। কেননা আমার কাছে তোর প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে।