এই ঝোপটা সাফ করছ কেন জলিল ভাই?
জলিল মিয়া অবাক হয়ে তাকায়।
কেন আবার, দেখছ না কেমন নোংরা হয়েছে।
নোংরা হলে কী হয়?
অতশত বুঝি না বাপু। তোমার বাবা বলেছে সাফ করতে।
ও, বাবা বলেছে বলে তুমি করছ।
সালমা একটু হতাশ হয়ে সরে আসে। জলিলকে আর ঘটায় না। ওর মেজাজটা একটু খিটখিটে। বেশি কথা বললে রেগে যায়। কামিনী ফুল গাছটার নিচে এসে দাঁড়ায় সালমা। ছোট্ট দুটো টুনটুনি পাখি ডালে ডালে লাফায়।
বুড়োদের নিয়ে যত জ্বালাতন!
কথাটা সালমা সবসময় বলে। ওর মতে, ষাট বছরের ওপরে আর কাউকে বাঁচতে দেওয়া উচিত না। এর মধ্যে কারো যদি স্বাভাবিক মৃত্যু না হয় তবে তাকে গুলি করে মেরে ফেলা দরকার। বাবা-মা ওর কথায় রাগ করে। আত্মীয়স্বজন বিরক্ত হয়। হলে কী হবে, সালমা অন্য কারো কথা মানতে রাজি নয়। ওর মতে প্রত্যেকেরই প্রচলিত ধারণাগুলো কিছু না কিছু বদলে ফেলা প্রয়োজন। তা না বুড়োগুলো পারে কেবল আঁকড়ে থাকতে। কোনো কিছু ভাঙতে হবে ভাবলে বুকটা ফেটে যায় ওদের। তাছাড়া বুড়ো বয়সটাও খারাপ। নতুন করে কিছু ভাবতে পারে না। এই যেমন জলিল মিয়া। খুব একটা বুড়ো হয়নি। তবু নিজের কোনো চিন্তা নেই। বাবা বলেছে বলে ঝোপটা পরিষ্কার করছে, আর কিছু ভাবতে পারছে না।
লাল রঙের একটা ফড়িং সালমার চারপাশে ঘুরে বেড়ায়। ও কামিনীর পাতা ছিড়ে হাত দিয়ে টুকরো করে। আসলে কিছু করার জন্য হাতটা নিশপিশ করে। জলিল মিয়া হাত-পা ছড়িয়ে ঘাসের ওপর বসে আছে। অল্প একটু কাজ করতে গেলেই হাঁপিয়ে ওঠে। সালমা ঘুরেফিরে আবার জলিলের কাছে আসে। স্যান্ডেল খুলে ঘাসের ওপর বসে।
আচ্ছা জলিল ভাই, কলাবতীর ঝোপটা পরিষ্কার করতে করতে তোমার কী মনে হয়েছে?
জলিল ভুরু কুঁচকে চুপ করে থাকে। কী যেন ভাবে। কৃষ্ণচূড়ার পাতার ফাঁকে চিরল রোদ এসে পড়েছে ওদের গায়ে। কলাবতীর মরাপাতার স্তুপের ওপর একটা হলুদ প্রজাপতি। জলিল বিড়ি বের করে ধরায়। সালমার সামনে ওর কোনো সংকোচ নেই। সালমার জন্মের আগে থেকে এ-সংসারে আছে ও। বিয়ের পরই সালমার বাবা ওকে গ্রাম থেকে নিয়ে এসেছে। তারপর থেকে জলিল মিয়া অন্য কোথাও যায়নি। সালমা কিছুক্ষণ জলিলের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। বয়সের চিহ্ন পড়েছে চেহারায়। রেখাগুলো স্পষ্ট। কালো মোটা ঠোঁটের ফাঁকে চিকন বিড়ি। কপালের ওপর থেকে অনেক চুল উঠে গেছে। অসম্ভব ঘোট চোখজোড়া প্রায় গর্তে ঢোকানো।
আমার কথার উত্তর দিচ্ছে না কেন জলিল ভাই?
সালমা একটু ধমকের সুরে কথা বলে। ওই লোকটার বুকের ভেতর কী ভাবনা তা ওকে জানতে হবে। করতোয়া নদীর পাড়ে বাড়ি ওর। অনেক দিন খেয়া পারাপারের কাজ করেছিল। এর বেশি কিছু সালমা জানে না। তবু লোকটাকে আজ জানতে হবে সালমার। ওকে বয়সে ধরেছে। ও এখন পৃথিবী সম্পর্কে বেশি কিছু ভাবতে চায় না। কিন্তু একদিন তো ওর যৌবন ছিল। সেই যৌবনের রেশ কি মনের কোথাও নেই? উত্তর দিতেই হবে সালমাকে। সালমা আজ ওকে ছাড়বে না। প্রায় ফিসিফিসিয়ে বলে, তুমি কী ভাবছ জলিল ভাই?
ভাবছি আমারও দিন ছিল আপামণি। বয়স থাকতে সেইসব দিন সাফ করিনি। এখন দেখি চারদিকে কেবল মরাপাতার বোঝ।
সালমার বুকটা ধক করে ওঠে। একটা মানুষের গোপন গুহার চিচিং ফাঁক হয়েছে ওর সামনে। হ্যাঁ, প্রত্যেকেরই কিছু না কিছু গুপ্তধন থাকে। নিরক্ষর জলিল মিয়াও তার বাইরে নয়। সালমা একটুক্ষণ চুপ থাকে। জলিল মিয়ার বিড়ি নিভে আসছে। চিরলপাতার ফাঁকে রোদ গরম হচ্ছে। এই লোকটাকে এক্ষুনি না ধরলে ও হয়তো পালাবে। আবার নিজের মধ্যে গুটিয়ে যাবে। ওকে এখনই ধরা চাই।
তুমি বিয়ে করোনি কেন জলিল ভাই?
বিয়ে? জলিল মিয়া হলুদ দাঁত মেলে হাসল। দিন থাকতে এক হিন্দু। বিধবা মেয়েকে ভালোবেসেছিলাম।
জলিল মিয়া আর একটা বিড়ি ধরায়।
বিয়ে হলো না কেন?
ও রাজি হলো না।
কেন?
সংস্কার।
সেই থেকে তুমি বিরাগী হলে? তুমি একটা পাগল।
জলিল মিয়া উত্তর দিলো না।
সালমা ভাবল, মনের মধ্যে এইসব আবর্জনা জমাতে নেই। জমালে ওই বোঝায় চাপা পড়ে মরতে হবে। নির্ঘাত মৃত্যু।
ওর নাম কী ছিল জলিল ভাই?
বরদা।
জলিল মিয়া উঠে চলে যায়। বসলে হয়তো সালমার আরো অনেক প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। এবং সেইসব প্রশ্নের উত্তর দিতে ও রাজি নয়। জলিল মিয়া বোঝা বাড়িয়েছিল কিন্তু ভার বইতে পারেনি। বরদা? ভালোবাসার নাম বরদা। ব-র-দা। সালমা টেনে টেনে উচ্চারণ করে। করতোয়া পাড়ের ছেলে খেয়া বাইত। খেয়া বাইতে বাইতে নিজেই ড়ুবে গেছে। কাকে আর পারাপার করবে ও?
সালমা বসে বসে ঘাসের ডাটা ছেডে। এখনো অনেক বাকি। ওই লোকটাকে আরো বেশি করে জানতে হবে। দেখবে কোন সমুদ্রে ওর ঠাঁই। কেমন করে দিনকাল পেরিয়ে অবলীলায় পাড়ি দিলো করতোয়ার উতল স্রোত? কলাবতীর ঝোপটা বেশ দেখাচ্ছে। কচি সবুজ পাতাগুলো আরো উজ্জ্বল। লাল-হলুদ ফুলের রোশনাই বেড়েছে। আসলে উপযুক্ত স্থানে উপযুক্ত জিনিস দরকার। বোঝা বাড়ালে সব ম্লান হয়ে যায়। ম্রিয়মাণ দেখায়। সব বাজে ভাবনা ঝেড়ে ফেলে অমন হালকা ফুরফুরে হয়ে যেতে ইচ্ছে করে সালমার।
অ্যাই লিমা?
বারান্দার ওপর থেকে মা ডাকছে। স্যান্ডেলে পা ঢুকিয়ে দাঁড়ায় ও। মা স্কুলে যাবার জন্য তৈরি হয়েছেন। কালো কাজ করা হলুদ শাড়ি পরেছেন। মাথায় প্রজাপতি খোপা। ঠোঁটে হালকা রং। হাতে ব্যাগ। সালমা আস্তে আস্তে সামনে এসে দাঁড়ায়। মার মুখ গম্ভীর।