কবে আসবে মিতালি?
আগামী পরশু।
ইস্, আরো দুটো দিন! তোর জন্য আমার কী যে কষ্ট হচ্ছে সাকিব। তোকে ঠিক বোঝাতে পারছি না।
সালমা নিজের মুখে দুঃখ ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করে। দিদিভাই, ও যদি আর না আসে?
কী হবে? মিতালির মতো কত ভালো মেয়ে আছে। মিতালি গেলে অন্য মিতালি আসবে।
যাহ্, তা কি হয়? মিতালি ছাড়া আমি আর কাউকে ভালোবাসতে পারব না। জানিস দিদিভাই, মিতালি না চমৎকার মেয়ে। ও আমাকে খুব ভালোবাসে।
বলতে বলতে সাকিবের মুখটা দোয়েলের চকচকে ডানার মতো পিছল হয়ে যায়। কিছু লজ্জা, কিছু তৃপ্তির সংমিশ্রণে সাকিবের দৃষ্টি গিটারের ঝংকারের মতো চঞ্চল হয়ে ওঠে। সালমা একটু ভাবে। সাকিব এখনো কত ছেলেমানুষ। ও নিজেকে আড়াল করে দাঁড়াতে পারে না, নিজেই ধরা পড়ে যায়।
বারান্দায় বাবা-মার পায়ের শব্দ পাওয়া যায়। পোশাক দেখেই সালমা আঁচ করে যে, ওরা বাইরে যাচ্ছে। বাবা গরদের পাঞ্জাবি পরেছে, মা জামদানি শাড়ি। নিশ্চয়ই কোথাও সভা আছে। তবু নিশ্চিত হবার জন্য সাকিবকে জিজ্ঞেস করে, বাবা-মা কোথায় যাচ্ছে সাকিব?
সেমিনার আছে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে।
উপলক্ষ? রবীন্দ্রজয়ন্তী।
অ।
জানিস দিদিভাই, বাবা না সামনের মাসে ভিজিটিং প্রফেসর হয়ে আমেরিকা যাবে।
তাই নাকি?
আমি বাবাকে একটা ভালো স্প্যানিশ গিটার আর পপ গানের রেকর্ড আনতে বলেছি। তুই কী আনতে বলবি?
কিছু না।
সে সময়ে ফোন বেজে ওঠে। বাবা-মা বেরিয়ে চলে গেছে। সাকিব উঠে যায় টেলিফোন ধরতে। সালমা আবার পত্রিকা হাতে উঠিয়ে নেয়। ভালো লেখা খুঁজতে থাকে। নৃতত্ত্বের ওপর প্রবন্ধ পড়তে ওর ভালো লাগে। মর্গানের বইটা ও খুঁটিয়ে পড়েছে। কিন্তু কোনো ম্যাগাজিনে মনের মতো লেখা পায় না। খোঁজাখুঁজিই সার।
দিদিভাই তোর টেলিফোন।
সাকিব বারান্দা থেকে চেঁচিয়ে ডাকে। সালমা অবাক হয়। কে আবার এই অসময়ে ওকে স্মরণ করল!
হ্যালো?
হ্যালো সালমা।
জমজমাট দুপুরের মতো ভরাট কণ্ঠস্বর। সালমার রক্ত ছলাৎ করে ওঠে। বহুদিন এই কণ্ঠ শোনার জন্য ও অপেক্ষা করেছিল।
চিনতে পারছ সালমা?
হুঁ। সালমা লম্বা করে বলে। তুমি আমাকে এ কদিন টেলিফোন করোনি কেন? আমি অনেকদিন ভেবেছি, আজ তোমার টেলিফোন পাব।
সত্যি!
সেই ভরাট কণ্ঠের হাসির শিহরণ সালমার কানে এসে আছড়ে পড়ে। সমুদ্রের ঢেউ যেন। সালমা কান পেতে শোনে। মনে হয় বুঝি ঠিক এমনি স্বরে ইভ নিষিদ্ধ ফল খাওয়ার মন্ত্র শুনেছিল। এরকম কণ্ঠই যে কাউকে যে-কোনো জায়গায় নিয়ে যেতে পারে।
হ্যালো সালমা?
বলো।
তুমি একটু থমকে গেলে যেন?
কই, না। তোমার হাসি শুনছি। অদ্ভুত কণ্ঠ তোমার।
তাই নাকি? জানো সালমা, তোমার কণ্ঠ আমার প্রাণে দখিনা বাতাসের মতো বয়ে যায়। আমি তোমার কণ্ঠের রং দেখতে পাই। সাইকেডেলিক কালার।
উহ্, আমারও তাই মনে হয়। মনে হয় তোমার কণ্ঠও সাইকেডেলিক কালার।
না তোমার।
না তোমার।
দুজনেই হাসে। সালমার রোমাঞ্চ লাগে। কেমন তীব্র আকর্ষণ অনুভব করে। ওর মনে হয় এ পর্যন্ত কোনো ছেলের জন্য ওর এমন আকর্ষণ হয়নি। এ লোকটা চুম্বকের পাহাড়ের মতো ওকে টানছে। সমুদ্রে ভাসা জাহাজের মতো সালমার অবস্থা। সেই পাহাড়ের টানে সালমা দিকভ্রষ্ট হয়েছে এবং মুহূর্তে সব রাশ ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে তার পায়ে চুর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাবার সাধ হয়। আবার নিজেকেই প্রশ্ন করে, কেন সালমা কেন? ওকে তুমি দেখোনি তাই? দেখলে তোমার সব ইচ্ছে কপূরের মতো উবে যাবে। আমি তো জানি তোমাকে সালমা। কাছে পেলে তুমি আর ফিরে দেখতে চাও না। এই তোমার স্বভাব। যে জিনিস তোমার নাগালের বাইরে তার জন্য তোমার দরদ বেশি।
হ্যালো সালমা?
তোমার সঙ্গে আমার কি একবার দেখা হয় না বন্ধু?
দেখা? কেন তার কি কোনো দরকার আছে? এই তো আমরা ভালো আছি সালমা। পরিচয়ের এ বৃত্তটা বড় বেশি নিঃস্বার্থ বলে অনেক আপন। অনেক ভালো লাগার।
তা হয় না সালমা।
কেন হবে না। একশ বার হয়।
জেদ করে না সালমা।
বেশ তোমার টেলিফোন নাম্বারটা আমাকে দাও। আমার যখন মন চাইবে তখন তোমাকে ফোন করব।
না, সালমা না। সময় বুঝে আমিই তোমাকে করব। তোমাকে নাম্বার দিলে তুমি হয়তো এমন মুহূর্তে টেলিফোন করবে যখন এই আমি, আমি থাকব না। অন্য মানুষ হয়ে যাব। জানো তো বেঁচে থাকার বিশেষ প্রয়োজনে মানুষ বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন আমি হয়ে যায়। আমি তোমাকে আমার এই মুহূর্তগুলো দিতে চাই, যা একান্তই আমার। আর কারো প্রবেশের অনুমতি নেই সেখানে।
তুমি কেবল নিজের দিকের কথাটা বললে।
উচ্ছল হাসি শোনা গেল। সালমা আরো অনেক কথা বলতে চেয়েছিল। বলতে চেয়েছিল এমন সময় তো আমারও থাকতে পারে বন্ধু, যখন সেই সময়ে এই আমি তোমার আমি থাকব না। অন্য কারো প্রবেশ থাকবে আমার অন্তরে। কিন্তু কিছুতেই বলতে পারল না সালমা। হাসির আড়ালে সব চাপা পড়ে গেল।
সালমা তোমার কণ্ঠই আমার কাছে তোমার পরিচয়। এর বেশি আমি কিছু চাই না। আমরা দুজনেই কণ্ঠের সাইকেডেলিক কালারে বেঁচে থাকব সালমা।
অপর পাশে টেলিফোন রাখার শব্দ হলো। সালমা রিসিভার হাতে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল।
দাঁড়িয়ে রইল দাঁত-ঠোঁট কামড়ে। ভাবল, হয়তো টেলিফোনে কথা। বলাটাই ওর বিলাস। এমনি আরো অনেক বন্ধু আছে ওর। টেলিফোনের। বাইরে সালমার কোনো দরকার নেই তার কাছে। ও মিছেই মাথা কুটে মরছে। সেই চুম্বকের পাহাড়ের কথা মনে হলো। ও চুম্বকের পাহাড়ের মতো! সমুদ্রের জাহাজগুলো অনবরত দিকভ্রষ্ট করছে। সশব্দে রিসিভারটা রেখে দেয় ও। কান্নার সঙ্গে ভেতর থেকে কী যেন বের করে। দিতে চায়। বাইরে জমজমাট নির্জন দুপুর হা হা করে।