আপামণি।
আনুর মা দরজা ফাঁক করে মুখ বাড়ায়।
আপনাকে খেতে ডাকে। সবাই বসে আছে।
আসছি।
সালমা দ্বিধায় পড়ে। সবাই বসে আছে? বিচারের দণ্ড নিয়ে? কিন্তু ওকে কিছু করার ক্ষমতা ওদের নেই। ওরা তো সালমার মতো মুক্ত মানুষ নয়। ওরা কী দণ্ড দেবে? ওদের মনে হাজারো ছিদ্র। ওই ছিদ্রপথে অনবরত দূষিত বাতাস বয়। ওরা সব দূষিত মানুষ। অপবিত্র। কলঙ্কিত।
সালমা পায়ে কোনো জড়তা না রেখে টেবিলে এসে বসে। মুখটা শিশির ধোয়া ফুলের মতো স্নিগ্ধ। তিনজনে এক পলক চায় ওর দিকে। কেউ কিছু বলে না। বাবা গম্ভীর। মা গম্ভীর। সাকিবের মুখটা ভীতু। সবাই যে যার প্লেটে খাবার তুলে নিচ্ছে। সালমার মজা লাগে। হাসিও পায়। তবু নিজেকে সংযত করে রাখে। ওরা যত বিজ্ঞ বিচারকের ভান করুক, ওদের হাতে বিচারের তুলাদণ্ড নেই। সবাই চুপচাপ খেয়ে যাচ্ছে। মা এটা-ওটা তুলে দেয়। সালমা আজ আর কোনো আপত্তি করে না। একসময় সালমার এই নিপ্রাণ পরিবেশ অসহ্য লাগে। কেউ কথা বলছে না কেন? সাকিবটাও যেন আজ বোবা হয়ে গেছে। ও-ই তো মাতিয়ে রাখে। আজ আবার কী হলো? খাবারগুলো সালমার তেতো লাগে। অর্ধেক খাবার প্লেটে রেখে উঠে পড়ে। বাবা আজ আর ওকে খাওয়ার জন্য সাধাসাধি করে না। ধমকও দেয় না। নিজের ঘরে আসতে আসতে সালমা শুনতে পায় টেবিল থেকে কথা ভেসে আসছে। স্পষ্ট শুনতে না পেলেন সালমা বুঝল, ওকে নিয়েই আলোচনা করছে ওরা। সামনে কিছু বলছে না কেন? বাবা কি বুঝেছে যে ও আজ তাকে কড়া জবাব দেবে? নাকি বেশি ভালোবাসায় ওকে শক্ত কথা বলতে বাধছে বাবার? সালমা খাটের সঙ্গে হেলান দিয়ে মেঝেতে হাত-পা ছড়িয়ে বসে। একগাদা পত্রিকা জমেছে। একদিনে একটাও দেখা হয়নি। একটু পর মা আসে।
লিমা।
কিছু বলবে মা?
হ্যাঁ, কথা ছিল।
সালমা হাতের পত্রিকা একপাশে রেখে সোজা হয়ে বসে।
বলো, কী বলবে?
তুমি এখন বড় হয়েছ লিমা—
সোজাসুজি বলো না।
বলছিলাম, আমাদের একটা মানসম্মান আছে। বিশেষ করে তোমার বাবার–
মানসম্মান নষ্ট হওয়ার মতো তেমন কিছু করিনি আমি। ভবিষ্যতে কী করি বলা যায় না।
লিমা।
তুমি অযথা কথা বলতে এসেছ মা।
রাগে গরগর করে ওঠে মা। পারলে এখুনি ঝাপিয়ে পড়ে মেয়ের ওপর।
কাল রাতে কোথায় ছিলে?
জেনে তোমার লাভ? চমৎকার একটা জায়গায় ছিলাম। অমন পরিবেশ তোমরা জীবনে তৈরি করতে পারবে না।
সালমার মুখে একটা পরিতৃপ্তির ভাব জেগে ওঠে।
আমি ভেবে দেখলাম মা, আমার এই তেইশ বছরের জীবনে তোমরা আমাকে একদিনও আনন্দের মধ্যে রাখখানি।
এসব কী বলছ তুমি? তোমার বাবা তোমার জন্য কী করে? অমন বাবা লাখে একটা মেলে।
হেসে গড়িয়ে পড়ে সালমা। হাসতে হাসতেই বলে, তুমি জেনে খুশি হবে না মা যে ওই বাবার পরিচয় দিতে আমার রীতিমতো লজ্জা হয়।
মার বড় বড় চোখ দিয়ে আগুন ছোটে। রাগে তোতলাতে থাকে। মুখ দিয়ে ঠিকমতো কথা বের হয় না। সেই সময়টুকুতে সালমা আবার মুখের ওপর পত্রিকা তুলে ধরে।
ধৃষ্টতার একটা সীমা থাকে লিমা। তুমি সেটাও পেরিয়ে গেছ। পড়তে অন্য কোনো বাবার হাতে, ঠিক টাইট থাকতে। লাই দিয়ে দিয়ে মাথায় উঠিয়ে রেখেছে তোমাকে।
সালমা চুপ করে যায়। আর কথা বলে না। রাগ না, ক্ষোভ না, অভিমান না, কিছুই ওকে ঘায়েল করতে পারে না। মা তার রাগের বদলে এক সবুজ প্রশান্তি ছড়িয়ে দিয়ে গেল। ওই দুপদাপ করে চলে যাওয়ার ভঙ্গি সালমা অনেক দেখেছে। দেখে দেখে মুখস্থ হয়ে গেছে। মা রাগের সময় কোন পা-টা আগে ফেলে, কোন পা-টা কতটুকু জোরে ফেলে তাও জানে সালমা। মাথাটা কোনদিকে বাঁকিয়ে রাখে সেটাও ওর জানা। সালমা ভাবল, মা এখন বিছানায় উপুড় হয়ে কান্না শুরু করেছে। কেঁদে কেঁদে বাবাকে অনেক কথা বলছে। বাবা চুপচাপ শুনছে। হয়তো পরে একসময় সালমাকে ডাকবে যেসব কথা শুনতে নসিয়ার মতো। লাগে সালমার।
পত্রিকা পড়তে পড়তে তন্ময় হয়ে যায় সালমা। আর সে সময়ে সাকিব এসে ঢোকে।
দিদিভাই কী করছিস? পড়ছিস?
সাকিব পাশে বসে। সালমা চোখ ওঠায় না। একটা চমৎকার গল্প পড়ছে ও। গল্পটা শেষ করে আগে। সাকিব দু-একটা পত্রিকা নাড়াচাড়া করে। আবার রাখে। উল্টেপাল্টে দেখে। হাই তোলে। দু-এক কলি গান গেয়ে আবার থেমে যায়।
কীরে অমন ছটফট করছিস কেন?
ধুৎ, কিছু ভালো লাগে না।
কী হলো আবার? একটা কড়া ঘুম লাগিয়ে দে।
ঘুম আসছে না যে।
সাকিব পোষা বেড়ালের মতো তুলতুলে ভাব করে। সালমা মুখটা গম্ভীর করে বলে, হুঁ বুঝেছি, কোথাও গড়বড় বাঁধিয়েছিস নিশ্চয়?
দেখ না দিদিভাই, মিতালি আমাকে কিছু না জানিয়ে চিটাগাং চলে গেছে।
কেন?
সামান্য একটু ঝগড়া।
সালমা হো হো করে হেসে ওঠে।
তুই হাসছিস দিদিভাই?
সাকিবের চোখ ছলছল করে। এক্ষুনি কেঁদে ফেলবে বুঝি। সালমার হাসি আর থামে না। সাকিব উঠে যেতে চায়। সালমা ওর হাত টেনে। ধরে।
বোস। তুই একটা পাগল।
বাবা-মা তোকে বলে পাগল আর তুই আমাকে বলিস পাগল। বেশ। বেশ।
সাকিব ন্যাকা মেয়েদের মতো মুখটা করুণ করে রাখে।
মিতালি তোর সঙ্গে ঝগড়া করল কেন?
ও করেনি। আমি করেছি।
কেন?
গত রোববার ও আর আমি সোনারগাঁ যাব বলে ঠিক করেছিলাম। শেষে ও আর যেতে রাজি হলো না। আমার রাগ হয়েছিল। আমি ওকে অনেক কড়া কথা বলেছিলাম। তুই বল দিদিভাই, তাই বলে আমাকে না। জানিয়ে চিটাগাং চলে যাবে?
তাই তো, ভারি মুশকিলের কথা। সালমা হাসি লুকিয়ে মাথা চুলকায়।