এই সালমা ওঠ? নাশতা খেয়ে নে।
খেলে হয় না, নাসিমা’পা?
সে কী কথা? জলদি উঠে পড়।
খিদে নেই। ওঠার তাগিদ অনুভব করে না সালমা। শুয়ে থাকতেই আরাম। এমন আরাম আর কি আছে? নাসিমা টেবিলে নাশতা খাচ্ছে। সালমা তাকিয়ে দেখে। এই ভোরবেলাতেও নাসিমা লম্বা লম্বা নখে গোলাপি কিউটেকস লাগিয়েছে। নখগুলো প্লেট এবং মুখের মাঝামাঝি ওঠানামা করছে। মন্দ লাগছে না দেখতে।
কিরে, হাঁ করে চেয়ে থাকলেই বুঝি পেট ভরবে?
সালমা তাড়াতাড়ি উঠে পড়ে। বাথরুমে ঢুকে মুখ-হাতে পানি দেয়। আয়নায় নিজেকে দেখে। চোখ দুটো ফুলো ফুলো। গাল ফুলো পতলের মতো দেখায় ওকে। গত রাতে খুলে রাখা শাড়িটা পরে। ইস্তিরি নষ্ট হয়ে গেছে। ভঁজ ঠিক নেই। মনটা খুঁতখুঁত করে।
নোংরা শাড়িটা পরলি কেন তুই? আমার একটা পরলে হতো?
থাকগে। একটু পরেই তো নিচে নেমে যাব।
তুই থাক না হয়। আমি পাবলিক লাইব্রেরিতে পড়তে যাব।
তা যাও। আমিও যাই। দেখি বাসায় কেমন ঝড় বইছে।
বকবে না তোকে?
বকলেই বা। কে গায়ে মাখে!
সালমা বাটি টেনে নিয়ে পুডিং খায়। নাসিমা উঠে পড়ে। ঘরে গিয়ে চুল আঁচড়ায়। শাড়ি পালটায়। তারপর সালমাকে খাবার টেবিলে রেখেই রওনা করে।
তুই খেয়েদেয়ে গান শোন, আমি আসি।
না, অতক্ষণ থাকব না। তুমি ছাড়া এ বাসায় একলা থাকা যায় নাকি?
কী করব বল? ভীষণ জরুরি–
জানি জানি। পড়া ছাড়া তুমি কিছু বোঝে না। যাও, আমি কিছু মনে করব না। খেয়েদেয়ে কাটব।
নাসিমা হেসে বেরিয়ে যায়। এই একটা ব্যাপারে নাসিমা খুব সিরিয়াস। তখন ডানে-বাঁয়ে তাকায় না। বসে বসে এক বাটি পুডিং খেয়ে ফেলে সালমা। নাসিমার অবর্তমানে ঘরটা সৌরভহীন মনে হয়। বুড়ি ঝি ঘর ঝাঁট দিচ্ছে। সালমার মনে হয় এখানে ওর আর কিছু করার নেই। নিজেকে পরিত্যক্ত কাপড়ের মতো লাগে। মুহূর্তের জন্য এই ঘরকে কেন্দ্র করে গত রাতের স্মৃতি সব ম্লান হয়ে যায়।
সালমা শ্লথ পায়ে বেরিয়ে আসে। বুড়ি ঝি পেছন থেকে দরজা বন্ধ করে দেয়। সালমা এক মুহূর্ত তাকায়। বন্ধ দরজার ওপর লাল পর্দা ঝুলছে। টকটকে লাল রং। সালমা মুখ ফিরিয়ে এক পা দু-পা করে সিঁড়ি দিয়ে নামে। মনে পড়ে একদিন ও এমনই এক পা এক পা করে সিঁড়ি দিয়ে নেমেছিল। সামনে ছিল জল টলটলে পুকুর। পুকুরের লাল পদ্ম। বারান্দার ওপর পা রাখতেই সাকিব চেঁচিয়ে উঠে, দিদিভাই? ছুটে আসে আনুর মা আর জলিল মিয়া। সে চিৎকারে সালমার কোনো ভাবান্তর হয় না। ও ভাবলেশহীন দৃষ্টিতে এদের দিকে তাকিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে পড়ে। ধপ করে বিছানার ওপর বসে বড় একটি নিঃশ্বাস ছাড়ে। সাকিব ওর পিছে পিছে ঘরে ঢোকে। আনুর মা আর জলিল মিয়া দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকে।
তুই কোথায় ছিলি দিদিভাই? বাবা-মা কাল সারারাত ঘুমোয়নি। ভোরেই দুজনে তোকে খুঁজতে বেরিয়ে গেছে।
কোথায়?
আত্মীয়স্বজনের বাসায়। পরিচিত সব জায়গায়।
ঠিকানা না জেনে ওভাবে খুঁজলে কি আর পাওয়া যায়?
সালমা শব্দ করে হেসে ওঠে। সে হাসি আর থামতে চায় না।
আহ্, দিদিভাই তুই কি পাগল হয়ে যাচ্ছিস? এই দিদিভাই?
সাকিব তুই এখন যা তো। আমার ঘুম পাচ্ছে।
সালমা বিছানায় শুয়ে পড়ে।
ফ্যানটা ছেড়ে দিয়ে যা। আর দরজাটা বন্ধ করে রাখিস।
সাকিব হাত উল্টে মুখভঙ্গি করে। কিছু বোঝার উপায় নেই। সালমার কথামতো ফ্যান ছেড়ে, দরজা বন্ধ করে বেরিয়ে আসে।
সালমা চোখ বুজে শুয়ে থাকে। কপালের ওপর শিথিল হাত গড়ায়। শাড়ি থেকে কেমন বমি বমি গন্ধ আসছে। গা গুলিয়ে ওঠে, উঠে বাথরুমে যায়। কাপড় ছেড়ে আসে। আলনা থেকে শাড়ি নিয়ে পরে। আবার শুয়ে পড়ে। এখন বেশ লাগছে। মাথাটা হালকা হয়েছে। চোখ বুজলে একজোড়া লাল জুতোর কথা মনে পড়ে সালমার। ক্লাস নাইনে পড়ার সময় বাবা ওকে একজোড়া লাল রঙের উঁচু হিলের স্যান্ডেল কিনে দিয়েছিল। ওই জুতোটা বেশিদিন পরতে পারেনি ও। মাস দেড়েক পরার পর পোলিও হয়েছিল। সেই ভীষণ অসুখটাকে মনে হয় ওর জীবনের একটা গভীর বাঁকবদল। অসুখের পর অনেক দিন লেগেছিল হাঁটা শিখতে। তারপর তো আর ওই জুতো পরার প্রশ্ন ওঠে না। এখনো সালমার কেন জানি ওই জুতোর কথা মনে হয়। অসুখের পর ওই স্যান্ডেল ওর সহ্য হতো না। ভাবতে গেলেই মনে হতো ওর একটা লাল অসুখ হয়েছে।
সালমা শুয়ে শুয়ে বারান্দায় পদশব্দ পেল। উৎকণ্ঠিত পদশব্দ। বোধহয় বাবা-মা।
ফিরেছে?
হ্যাঁ।
কোথায়?
ঘুমিয়েছে। এখন জাগিয়ো না।
সাকিবের কথায় আশ্বস্ত হয় সালমা। যাক, কিছুটা বুদ্ধি রাখে তাহলে। তবু ঘুমের ভান করে পড়ে থাকে। নিঃশব্দে বাবা ঢোকে ঘরে, সালমার মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ে কী যেন দেখে।
সালমা টের পায় কিন্তু নিঃসাড় পড়ে থাকে। মনে মনে ভাবে, জাহিদ চৌধুরীর মোটা বুদ্ধি। সাধ্য নেই সালমার অভিনয় ধরার। তেমন সূক্ষ্ম শিল্পিত মন থাকলে ঠিক বুঝত সালমার প্রাণ এখন কোন কাঁটায় ঘুরছে। ভালোবাসা ভালোবাসা বলে বাবা চেঁচায়। কিন্তু ভালোবাসার সেই তীব্র স্পর্শবোধ কই যে, ঘ্রাণেই বুঝে নেবে ওকে?
বাবা যেমনি এসেছিল তেমনি আবার বেরিয়ে যায়। মা বারান্দায় চেয়ারে বসে গজগজ করছে। কত অজস্র কথা বলছে। এই মেয়ে না থাকলে বা কী–
এমন কথাও উচ্চারণ করছে। বাবা কিছু বলছে না। রাত জাগার ক্লান্তি দুজনের চেহারায়। সাকিবও বসে আছে বারান্দায়। ওরা সবাই বসে আছে সালমার অপেক্ষায়। কখন ওর ঘুম ভাঙবে। কখন ও কথা বলবে।
শেষ পর্যন্ত ঘুম আর আসে না সালমার। দুপুর পর্যন্ত মিছেমিছি শুয়ে থাকে। তারপর উঠে গোসল করে। মাথা আঁচড়ায়। লম্বা চুল পিঠের ওপর ছড়িয়ে দেয়। জানে এখুনি ওকে খেতে ডাকবে। একটুক্ষণ জানালার কাছে দাঁড়ায়। খরগোশের বাক্সটা দেখা যায়। খরগোশ দুটো বাক্সের ভেতরে দৌড়াদৌড়ি করছে। সালমার হাসি পেল। ওরা খেলছে। কী খেলা করছে? ওরা কি আবাল খেলা খেলবে?