তবে তোমরা কেমন করে খাও?
নাসিমা হাসে।
এখানেই তো মজা। এজন্যই তো একে বলে মাদকদ্রব্য। আমি বলি মামদো ভূত! একবার পেয়ে বসলে ওইসব তেতো-ফেতে কিছু না। পথিবীর শ্রেষ্ঠ বস্তুর চাইতেও সুস্বাদু মনে হয়। নাসিমা অনেক কথা বলে যায়। সালমার কানে কিছু ঢোকে না। মামদো ভূত শব্দটা মনে মনে আউড়ে যায়। নাসিমা’পা একটা শব্দ বের করেছে। একবারের জন্য হলেও ওই অনুভূতির স্বাদ সালমার চাই।
কিরে কী ভাবছিস?
মামদো ভূত—
নাসিমা শব্দ করে হাসে।
তোর সাব্বির ভাইয়েরও ওই শব্দটা খুব পছন্দ। যখন তখন বলবে, নাসিমা তোমার মামদো ভূতটা আমার ঘাড়ে চাপাও।
নাসিমা’পা আমিও তাই চাই।
পাগল! সহ্য করতে পারবি না।
পারব। তুমি দেখে নিয়ে ঠিক পারব।
সালমা জোর দিয়ে কথা বলে।
বলো, তুমি দেবে?
সালমা নাসিমার গলা জড়িয়ে ধরে।
আচ্ছা, আচ্ছা দেব। বেলা পড়ক। বিকেলের পর, সন্ধ্যার আগে। এই মাঝামাঝি সময়টা আমার খুব পছন্দ।
সালমা পর্দা ফাঁক করে জানালা দিয়ে বাইরের আলো দেখে। বিকেল নিস্তেজ হয়ে এসেছে। নিচতলা থেকে আনন্দমুখর কথাবার্তা ভেসে আসছে। উৎসব জমে উঠেছে। একতলায় এখন অনেকগুলো রঙিন বাতি জ্বলছে। লাল নীল সবুজ হলুদ। সালমার হঠাৎ মনে হয়, সাকিবের গিটারের শব্দ আসছে। কান পেতে শোনে। হ্যাঁ, ঠিকই। কোনো ভুল নেই। অতিথিদের অনুরোধে সাকিব হয়তো গিটার বাজাচ্ছে। সালমার কান দুটো ঝাঁ ঝাঁ করে ওঠে। জানালা বন্ধ করে দিয়ে নাসিমার ডিভানের পাশে এসে দাঁড়ায়।
নাসিমা’পা ওঠো। তোমার প্রিয় সময় পার হয়ে যাচ্ছে।
প্রথম প্রথম সালমা কিছু বুঝতে পারে না। খেতে গিয়ে মুখটা বিকৃত করে মাত্র। তীব্র নসিয়া পেয়ে বসে ওকে। দিশেহারার মতো চারদিকে তাকায়। প্রচণ্ড অস্বস্তি বুকের আকাশে মেঘের মতো গুরুগুরু শব্দ করে। নাসিমা খিলখিল করে বলে, বাবা, বলছিলাম না, মামদো ভূত। ঘাড় ধরে যেদিকে ঘোরাবে ঠিক সেদিকে ঘুরতে হবে। ছাড়াছাড়ি নেই।
নাসিমার এলোমেলো ভঙ্গ কণ্ঠ ফ্যাসফ্যাস করে। বিননি খুলে চুলগুলো ছড়িয়ে দেয় পিঠে। শাড়িটা খুলে দলামোচা করে ছুড়ে মারে সোফায়। তারপর টলতে টলতে চলে যায় শোবার ঘরে। সালমা আর নিজেকে চেপে রাখতে পারে না। পেটের ভেতর একটা দৈত্য যেন লঙ্কাকাণ্ড বাধিয়ে তুলছে। কিছুতেই তাকে আর ঠেকিয়ে রাখা যাচ্ছে না। সালমা অন্ধকার হাতড়ে বাথরুমের দরজা খুলে হড়হড় করে বমি করে। দুপুরে খাওয়া নাসিমার প্রিয় রান্নাগুলো সব উঠে আসে। অবসন্ন দুর্বল লাগে। মুখে হাতে পানি দেয়। শাড়ি ভিজে যায়। খুলে বাথরুমে রাখে। ফিরে এসে ডিভানের ওপর শুয়ে পড়ে। বমি বমি গন্ধ আসে শরীর থেকে। কোনো কিছুই এখন আর ওর খারাপ লাগছে না। অবদমিত ইচ্ছেটা ঘুরেফিরে মনের মধ্যে নড়াচড়া করে। যেটা পারবে বলে দুম্ভ করেছে, সেটা পারেনি। পরাজয়ের গ্লানি মনকে সংকুচিত করে রাখে। উপরন্তু মিউজিকের রংটা দেখা হলো না। কোনো অভিজ্ঞতাও হলো না সালমার। নিজেকে সান্ত্বনা দেয় ও। প্রথম দিন পারেনি বলে দুঃখ কী? আবার চেষ্টা করবে, আবার। মামদো ভূত আর যেই ভূতই হোক বাগে আনতেই হবে সালমার। ইচ্ছের পরাজয় কখনোই হতে দেবে না।
চোখ জড়িয়ে আসে। মনে হয় ওর চারপাশে সাকিব খুব মিষ্টি করে। গিটার বাজাচ্ছে। খুব মোলায়ম আঙলে তার স্পর্শ করছে। নাইটিঙ্গেলের গান যেন। সাকিব তুই কত ভালো–তুই বুঝেছিস এখন আমার ঘুম দরকার। প্রিয় ঘুম। প্রিয়তম ঘুম। সালমার ঠোঁটজোড়া কেঁপে কেঁপে থেমে যায়।
বাইরে রাতের শরীরে যৌবনের ছোঁয়া লাগে।
০৫. সকালে অনেক বেলায় সালমার ঘুম ভাঙে
সকালে অনেক বেলায় সালমার ঘুম ভাঙে। বুড়ি ঝি এসে তার নিত্যদিনের কাজে লেগেছে। নাসিমা গোসল সেরেছে। ঘরদুয়োর গোছায়। ফুলদানিতে ফুল বদলিয়ে নতুন ফুল সাজায়। জানালা-দরজা সব খোলা। চোখ ধাঁধানো আলোয় ঝলমল করছে সবকিছু। মৃদু হাওয়ায় পর্দা দোলে। নাসিমা ওর দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসে।
কী, ঘুম ভাঙল মেম সাহেবের?
সালমা লাজুক হাসে, উঠতে ইচ্ছে করে না। আর একটু গড়িয়ে নিতে চায় শরীর। অলস অলস ভাব দেহের জোড়ায় জোড়ায়।
থাক, উঠতে হবে না। ঘুমা।
নাসিমার কথায় আবার শুয়ে পড়ে। এটাই চাচ্ছিল ও। তবু নাসিমার সামনে শুয়ে থাকতে একটু লজ্জা লাগছিল। অনুমতি পাবার পর আর দেরি কী? কিন্তু শুলে কী হবে! ঘুম আর এলো না। বুড়ি ঝি এক কাপ চা দিয়ে গেল। গরম চায়ে অলসভাব কেটে যায়। আর তখুনি বাড়ির কথা মনে হয় সালমার। কাল সারারাতে একবারও মনে হয়নি। কী হচ্ছে সারা বাড়িতে? চিন্তা করতে গিয়েই মজা লাগল। ওরা ভাবুক। ভেবে ভেবে সারা হোক। সালমা চোখ বুজে শুয়ে থাকে। নাসিমা বই নিয়ে বসেছে। বাসন্তী রং শাড়ি পরেছে। হালকা সেন্ট মেখেছে গায়ে। বেশ মিষ্টি গন্ধ আসছে। সালমা ভাবল, নাসিমা’পার চারদিকে রুচির ছড়াছড়ি। তার কোনো কাজই রুচি বা আনন্দের বাইরে নয়। কোনো কাজে জোরজবরদস্তি নেই। শিল্পিত চেতনা পরিবেশিষ্ট বলে নাসিমা’পার হৃদয় সমুদ্রের মতো। ব্যাপ্তি গভীরতার রঙে কোথাও কোনো কমতি নেই। পাশাপাশি সাব্বিরকেও ভেবে দেখল সালমা। সাব্বির ভাইও ভালো। সুন্দর মানুষ। নাসিমা’পাকে অনেক কিছুর বিনিময়ে ভালোবাসে। সবচেয়ে বড় কথা নোংরামির উর্ধ্বে নিজেকে পরিষ্কার রাখতে পারে। সালমার মনে হয় প্রতিটি মানুষের এটাই সবচেয়ে বড় গুণ হওয়া দরকার। সবকিছুর ঊর্বে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত রাখা। নইলে নীচতা এসে ব্যক্তিত্বকে ছিন্নভিন্ন করে। মানসিকতায় ওরা চমৎকার। অথচ দজনে এমন একটা জীবনযাপন করে, যেখানে সমাজের কোনো স্বীকৃতি নেই। তাতে কি ওদের কিছু এসে যায়? ওরা তো আপন বৃন্তে ফুল ফোঁটায়, আনন্দের ফোয়ারা ছোটায়–রঙের আকাশ গড়ে তোলে। আর কী চাই? এমন নিবিড় প্রশান্তি পেলে সালমার হয়তো আর কিছু চাওয়ার থাকত না।